হাওড়ার গঙ্গাতীর ‘তিব্বতি বাগানে’ মাথা তুলে আছে বৌদ্ধমঠ

হিমালয় অঞ্চলের একাধিক জায়গাতে তো অনেক বৌদ্ধ মঠ বা মনেস্ট্রি তো দেখেছেন কিন্তু কখনো সমতলে বৌদ্ধ মঠ দেখেছেন? তাও কিনা আবার হুগলি নদীর তীরে? শুনতে…

হিমালয় অঞ্চলের একাধিক জায়গাতে তো অনেক বৌদ্ধ মঠ বা মনেস্ট্রি তো দেখেছেন কিন্তু কখনো সমতলে বৌদ্ধ মঠ দেখেছেন? তাও কিনা আবার হুগলি নদীর তীরে? শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। উইকেন্ডের একটা ছুটিতে টুক করে ঘুরে আসাই যেতে পারে। না না এখানে যেতে গেলে কোনো পাহাড় পর্বত ভাঙতে হবে না।

 

   

প্রথমেই হাওড়ার ঘুসুড়িতে চলে যান। তবে গুগল ম্যাপের সাহায্য না নেওয়াই ভালো হবে,স্থানীয়রাই আপনাকে ভালো সাহায্য করতে পারবেন জায়গাটি চিনতে। এই বৌদ্ধ মঠটির নাম হল ভোট বাগান, বা ‘তিব্বতি বাগান’। এই মঠটি ১৭৮০ সালে তৈরি হয়েছিল। এটিকে হিমালয়ের বাইরে প্রাচীনতম তিব্বতি বৌদ্ধ মঠ বলে মনে করা হয়। গোসাই ঘাট পেরোলেই আপনি এই জরাজীর্ণ মঠটি দেখতে পাবেন।

বলা হয়, এই মঠটি নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিল ভুটান ও কোচবিহারের তৎকালীন রাজা। জানা গিয়েছে তৎকালীন বাংলার গর্ভনর ওয়ারেন হেস্টিংস, পাঞ্চেন লামা, পুরাণ গিরির হাত ধরে তৈরি হয়েছিল এই মঠটি।

১৭৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হাওড়ার ঘুসুড়ির পুরঙ্গিরকে ৩০ বিঘা জমি লিজ দেয়। অল্প সময়ের মধ্যে, মন্দির এবং ভবনগুলি আসতে শুরু করে এবং 30 বিঘা 150 বিঘা ফ্রিহোল্ড জমিতে প্রসারিত হয়। প্রথম থেকেই, ভট বাগান মিশ্র ধর্মের একটি স্থান, তান্ত্রিক অনুশীলনের সাথে হিন্দু ধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের সংমিশ্রণ।

প্রারম্ভিক দিনগুলিতে, পাঞ্চেন লামা তিব্বত থেকে বেশ কয়েকটি আইটেম নিয়ে এসেছিলেন, যার মধ্যে মহাকাল এবং তারার মূর্তি অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই সঙ্গে এল ১০০ পিস সোনা, কার্পেট ও কাপড়ের ব্যানার। মহাকালের প্রতিমা অবশ্য ছিল মূল আকর্ষণ। এটি মূল্যবান ধাতু দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এবং এতে নয়টি মাথা, ১৮ টি পা এবং ৩৬ টি বাহু ছিল, প্রতিটি একটি অস্ত্র ধরে ছিল এবং একটি মহিলা সঙ্গিনীকে ধরে রেখেছিল।

 

লামার ইচ্ছা অনুযায়ী ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে, মঠ তৈরির জন্য ওয়ারেন হেস্টিংস গঙ্গার পাড়ে হাওড়া জেলার ঘুশুড়ী অঞ্চলে ১০০ বিঘা ৮ কাঠা জমি পাঞ্চেন লামাকে ভাড়ায় দেন, যা ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে আইনতভাবে পাঞ্চেন লামার করমুক্ত জমি হিসাবে বিবেচিত হয়। এবং এরও পরে ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে আরও ৫০ বিঘা জমি (যা একসময়ে শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণের ও আন্দুলের রাজা রাজচন্দ্র ওরামলোচনের জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত ছিল) সম্প্রসারিত হয়, যা চারটি সনদের মাধ্যমে পাঞ্চেন লামাকে ও পরবর্তীকালে তা পুরাণ গিরিকে বন্দোবস্ত করে দেন। এভাবেই গঙ্গার পাড়ে প্রায় ১৫০ বিঘা জমির ওপর পাঞ্চেন লামার নির্দেশে ও পুরাণ গিরির তত্ত্বাবধানে শুরু হল বৌদ্ধ মঠ তৈরির কাজ। মঠের পুরো পরিকল্পনা করেন স্বয়ং পাঞ্চেন লামা। গঠনে প্রায় চতুষ্কোণ এই মঠের মধ্যেকার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে গঠন করা হয়েছিল এক সুন্দর উদ্যান (বাগান), যা থেকেই নামকরণ ভোটবাগান মঠ বা তিব্বত উদ্যান।

মঠের প্রধান প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকে উন্মুক্ত প্রাঙ্গনের বিপরীত অংশে দালান-রীতির গঠনে তৈরি হওয়া মঠের মন্দির, যেখানে এখনও পুরাণ গিরির সংগৃহীত সেইসব তিব্বতি মূর্তিগুলি শোভা পাচ্ছে। প্রাঙ্গনের বামদিকে গঠন করা হয়েছে দ্বিতল ভবন, যেখানে মঠের বিভিন্ন মোহান্ত মহারাজদের থাকার জায়গা। আর মঠের ডানদিকের অংশে ছিল নদীর ঘাটে যাওয়ার রাস্তা, যেখানে মঠের সন্ন্যাসীদের জন্যই গঠন করা হয়েছিল ঘাট।