‘একজন ইউরোপীয়ও থাকবে না মেদিনীপুরে’, ফাঁসির আগের হুঙ্কার চমকে দিয়েছিল বার্জকে

বিশেষ প্রতিবেদন: ১২ জানুয়ারি ১৯৩৩। জেলের ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা। কনকনে ঠান্ডা। তত ক্ষণে প্রদ্যোতের স্নান সারা। গীতাপাঠও করে নিয়েছেন। ছ’টা বাজতে তিন মিনিটে তাঁকে নিয়ে…

pradyot kumar bhattacharya

বিশেষ প্রতিবেদন: ১২ জানুয়ারি ১৯৩৩। জেলের ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা। কনকনে ঠান্ডা। তত ক্ষণে প্রদ্যোতের স্নান সারা। গীতাপাঠও করে নিয়েছেন। ছ’টা বাজতে তিন মিনিটে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল ফাঁসির মঞ্চে। জেলের বিভিন্ন সেল থেকে গর্জন, ‘প্রদ্যোৎ কুমার কি জয়।’ মঞ্চের ওপরে দাঁড়ালেন।

নিহত ডগলাসের পরবর্তী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ বার্জ জিজ্ঞেস করলেন,‘Are you ready?’ শান্ত ভাবে প্রদ্যোৎ বললেন, ‘One minute please Mr. Burge, I have something to say.’ বার্জ অনুমতি দিলেন। এ বারে প্রদ্যোৎ হাসতে হাসতে বললেন,‘We are determined, Mr. Burge, not to allow any European to remain at Midnapore. Yours is the next turn. Get yourself ready.’ (এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছিল। মাস সাতেক বাদেই বার্জকে হত্যা করেন বিপ্লবীরা।) একটু থেমে আবার বললেন, ‘I am not afraid of death. Each drop of my blood will give birth to hundreds of Prodyots in all houses of Bengal. Do your work please.’ কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা পড়ল। ফাঁসির দড়ি পরানো হল। শেষ বারের মতো উচ্চারণ করলেন, ‘বন্দে মাতরম’। দুই দাদা, প্রভাতভূষণ ও শক্তিপদ দেখলেন সেই মৃত্যুদৃশ্য।

ধীরস্থির, শান্ত, প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য ১৯৩০ সালে মেদিনীপুরের হিন্দু স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করে, স্থানীয় কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। তার পরেই জীবন পালটে গেল। অথচ তাঁর পরিবারে কেউ কখনও স্বদেশি করেননি। বাবা ছিলেন রেভিনিউ এজেন্ট। বড় ভাই ডাক্তার। মেজ ভাই সাউথ ইস্টার্ন রেলের কর্মী।

এক সময়, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার বা বিভি মেদিনীপুর শাখার নিষ্ঠাবান যোদ্ধা দীনেশ গুপ্তের সান্নিধ্যে আসেন প্রদ্যোৎ। তখন প্রদ্যোতের সবে সতেরো। দীনেশ জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি জানো, ধরা পড়লে ফাঁসি, দ্বীপান্তর, অকথ্য অত্যাচার, ভাগ্যে যা খুশি জুটতে পারে। হাসিমুখে সইতে পারবে?’ প্রদ্যোৎ বললেন, ‘নিশ্চয়ই।’ ‘মন্ত্রগুপ্তি রক্ষা করতে পারবে?’ ‘পারব।’ ১৯৩০-এ প্রদ্যোৎকে দলে নিলেন।

মেদিনীপুর সংস্থার পরিচালনার ভার পড়েছিল প্রফুল্ল দত্তের ওপর। তিনি বললেন, ‘বাঃ, এই তো সাচ্চা দীনেশ গুপ্তের ভাবশিষ্য। নামেও কচি (প্রদ্যোতের ডাকনাম), বয়সেও। তবু কাজে লাগানো যেতে পারে।’ এই প্রদ্যোৎই জেল ম্যাজিস্ট্রেট প্যাডি হত্যার প্ল্যান করার জন্য ২৫ মার্চ ১৯৩২-এ সন্ধে সাতটায়, ফণী কুণ্ডু, জ্যোতিজীবন, বিমল দাশগুপ্ত এবং প্রফুল্ল দত্তের সঙ্গে দেখা করলেন, স্টেশনের নির্জন মাঠে। কিছু দিন পরে এক সন্ধেয়, একটি জেলা স্কুলশিক্ষা প্রদর্শনীতে হঠাৎ রিভলভারের গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়লেন অত্যাচারী প্যাডি। হত্যাকারী জ্যোতিজীবন ঘোষ এবং বিমল দাশগুপ্ত তখন বিদ্যুৎগতিতে সীমানার বাইরে।

তার পরে শুরু হল পরবর্তী ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাসকে হত্যার পরিকল্পনা। প্রভাংশুশেখর পাল এবং প্রমথ মুখোপাধ্যায়ের ওপর পড়ল দায়িত্ব। কংসাবতী নদীর তীরে ওঁরা অপেক্ষায়। ডগলাস বোটে করে পার হবেন। কথা ছিল, গাড়ি থেকে নামলেই গুলি। কিন্তু সে দিন তিনি নামলেন না। অভিযান ব্যর্থ। কিন্তু একটা জিনিস পরিষ্কার হল। প্রমথ ভীষণ নার্ভাস। অতএব তাঁকে বাতিল করে, এলেন প্রদ্যোৎ।

৩০ এপ্রিল ১৯৩২। দুপুর পৌনে দুটো। ডগলাস ব্যস্ত জেলা মিটিং-এ। প্রদ্যোতের চোখে চশমা। সিঁথিটা অন্য দিকে কাটা। প্রভাংশুর মোটা গোঁফ, মালকোঁচা মারা ধুতি। দুজনেই ছদ্মবেশে। প্রহরীরা কিছু বোঝার আগেই দুজন তীব্র গতিতে একেবারে ডগলাসের পিছনে। গুলি ছুড়লেন। তার পর ওঁরা ছুটছেন। গুলি ছুড়তে ছুড়তে প্রভাংশু অমর লজের পাশ দিয়ে পালালেন। পথে একটি সাঁকোর তলায় রিভলভারটি পুঁতে সাধারণ পোশাকে অদৃশ্য হলেন। প্রদ্যোতের ভাগ্য সে দিন বিরূপ। পিছনে প্রহরীদের চিৎকার— পাকড়ো পাকড়ো। গুলি ছুড়তে ছুড়তে তারা পিছু নিয়েছে। প্রদ্যোৎ ঘুরে বার বার রিভলভারের ট্রিগারে চাপ দিলেন। কিন্তু গুলি বেরল না। দৌড়তে দৌড়তে একটি পোড়ো বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লেন। বন্দুকে নতুন গুলি ভরতে চেষ্টা করলেন। ইতিমধ্যে কপাটহীন ঘরে ঢুকে এক জন গুলি চালাল।

প্রদ্যোৎ ঘর থেকে বেরিয়ে উত্তর দিকে দৌড়লেন। বন্দুক তাক করে আবার ট্রিগারে চাপ দিলেন। নাঃ, এ বারেও গুলি বেরোল না। শেষে ঝোপ-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সরু গলি ধরে পালাচ্ছেন, হঠাৎই কাঁটাতারের বেড়ায় কাপড় জড়িয়ে ছিটকে পড়লেন। ইটের টুকরো এসে লাগল মুখে। রিভলভার ছিটকে পড়ল দূরে। ব্যস, তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রাজভক্তের দল। এলোপাথাড়ি মার। রক্তাক্ত প্রদ্যোতের চোখে তখনও আগুন। পকেট থেকে পাওয়া গেল দু’টুকরো কাগজ। একটিতে লেখা: ‘A fitting reply to premeditated and prearranged barbarous & cowardly attempt on the patriotic sons of Bengal— Bengal revolutionaries.’ অন্যটিতে: ‘হিজলী হত্যার ক্ষীণ প্রতিবাদে— ইহাদের মরণেতে ব্রিটেন জানুক। আমাদের আহুতিতে ভারত জাগুক— বন্দেমাতরম।’ প্রচণ্ড অত্যাচার চলল প্রদ্যোতের অলিগঞ্জের বাড়িতেও। ঘরের আসবাব ভেঙেচুরে তছনছ। প্রদ্যোতের মা’কে কটূক্তি। বড় ভাই আর মেজ ভাই তখন গ্রামে ছিলেন না। তখন, প্রদ্যোতের ঠিক ওপরের ভাই শর্বরীভূষণকে থানায় নিয়ে যাওয়া হল।

ও দিকে হাজার জেরা, শত অত্যাচারেও প্রদ্যোতের মুখ থেকে একটা কথাও বেরোয়নি। বেরোয়নি সঙ্গী প্রভাংশু বা অন্য কারও নাম। স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টায় যখন ভূপেন দারোগা ব্যঙ্গ করে প্রশ্ন করেন, ‘ছিঃ প্রদ্যোৎ, তোমার মতো বুদ্ধিমান ছেলে এমন ভুল করল? শেষে কিনা তুমি এমন একটা রিভলভার নিয়ে গেলে, যা কাজের বেলায় একেবারেই সাড়া দিল না!’ শিকল-বাঁধা দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রদ্যোৎ বলেছিলেন: ‘Irony of fate, Bhupen-babu, had my revolver spoken out, I would not have been here and in this condition, the story would have been otherwise.’ রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দ-নজরুল তাঁর জপতপ ছিলেন। আশপাশের সেল থেকে, এমনকী প্রহরীও শুনত তাঁর গান। বিপ্লবী ভূপাল পান্ডা তখন একই জেলে। তিনি লিখছেন: …সন্ধ্যায় লকআপের পর হঠাৎ শোনা গেল প্রদ্যোতের মধুর কণ্ঠের গান, রবীন্দ্রনাথের ‘তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে/ তা ব’লে ভাবনা করা চলবে না।’ কখনও বা কাজী নজরুলের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু…’

সে দিন তাঁর বয়স ছিল মাত্র আঠারো বছর…’ চিঠিটি জেল কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে পাঠিয়েছিলেন তাঁর মা’কে। কিছু কিছু অংশ: ‘কিন্তু আজ একটা আদর্শের জন্য প্রাণ বিসর্জন করছি। তাতে আনন্দ আমার মনের কানায় কানায় ভরে উঠেছে। …ফাঁসির কাঠটা আমার কাছে ইংরেজের রসিকতা মনে হচ্ছে। আমার এই অন্তরের কথাটা তোমারই অন্তরের প্রতিধ্বনি। আমি চিরদিনই জানি যে, আমি বাঙালী (বা ভারতবাসী) আর তুমি বাংলা (বা ভারতবর্ষ) একই পদার্থ। যুগ যুগ ধরে তুমি যে অপমান, লাঞ্ছনা ও নির্যাতন সহ্য করে এসেছ, মাটিতে মুখ থুবড়ে বোবা গরুর মতো মার খেয়েছ, তারই বিরুদ্ধে তোমার মনে যে বিদ্রোহের ধারা অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো বয়ে যাচ্ছিল, সেই পুঞ্জীভূত বিদ্রোহ-ই আমি।’

‘বিপ্লব জিনিসটা কিছু আমোদের নয়, কিন্তু মানব জাতিকে ধ্বংসের হাত হতে বাঁচানোর জন্য যুগে যুগে এটার প্রয়োজন হয়েছে।’

‘যাঁদের প্রতিটি রক্তবিন্দু দাসত্বের কলঙ্কে কলঙ্কিত হয়ে গেছে তাঁদের কথা ভাবি না। …কিন্তু যাঁরা মধ্যপন্থী, আপস মীমাংসায় এখনো বিশ্বাসবান, তাঁদের জন্য দুঃখ হয়।’

রাজবন্দি কৃষ্ণলাল চট্টোপাধ্যায় ফাঁসির আগের দিন দেখা করে কানে কানে বললেন, ‘ভাই, কাউকে কিছু বলবার আছে কি?’ প্রদ্যোৎ বললেন, ‘আমার প্রতিটি রক্তবিন্দুতে যেন একটি করে শহিদ তৈরি হয়।’

এল শেষের সে দিন। ১২ জানুয়ারি ১৯৩৩। জেলের ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা। ঢং ঢং শব্দে জেগে উঠল ভোর। কনকনে ঠান্ডা। চার দিকে কুয়াশা। তত ক্ষণে প্রদ্যোতের স্নান সারা। গীতাপাঠও করে নিয়েছেন। ছ’টা বাজতে তিন মিনিটে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল ফাঁসির মঞ্চে। জেলের বিভিন্ন সেল থেকে গর্জন, ‘প্রদ্যোৎ কুমার কি জয়।’ মঞ্চের ওপরে দাঁড়ালেন। নিহত ডগলাসের পরবর্তী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ বার্জ জিজ্ঞেস করলেন,‘Are you ready?’

শান্ত ভাবে প্রদ্যোৎ বললেন, ‘One minute please Mr. Burge, I have something to say.’ বার্জ অনুমতি দিলেন। এ বারে প্রদ্যোৎ হাসতে হাসতে বললেন,‘We are determined, Mr. Burge, not to allow any European to remain at Midnapore. Yours is the next turn. Get yourself ready.’ (এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছিল। মাস সাতেক বাদেই বার্জকে হত্যা করেন বিপ্লবীরা।) একটু থেমে আবার বললেন, ‘I am not afraid of death. Each drop of my blood will give birth to hundreds of Prodyots in all houses of Bengal. Do your work please.’ কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা পড়ল। ফাঁসির দড়ি পরানো হল। শেষ বারের মতো উচ্চারণ করলেন, ‘বন্দে মাতরম’। দুই দাদা, প্রভাতভূষণ ও শক্তিপদ দেখলেন সেই মৃত্যুদৃশ্য।

এর পরের ইতিহাস আরও করুণ। শর্বরীভূষণের সঙ্গে বিপ্লবী দলের কোনও যোগাযোগ ছিল না। হ্যাঁ, প্রদ্যোতের পিঠোপিঠি ভাই হিসেবে কিছু হয়তো জানতেন। সন্দেহের বশে তাঁকেও জেলে পোরা হল। চলল অকথ্য অত্যাচার। চার বছর জেল-হাজত, তার পর শর্বরী অত্যাচারের চোটে পাগল হয়ে গেলেন। রাঁচির উন্মাদ আশ্রমে বাকি জীবন কাটাতে হল। ১৯৮০ সালের ২৮ মার্চ মারা যান। তখনও জানতেন না, দেশ স্বাধীন হয়েছে।