অগ্রহায়ণে এই পরিবারে ‘কাত্যায়নী’ দুর্গা আরাধনা হয়

হাওড়া জেলার আমতা ব্লকের রাউতরা গ্রামে রায় পরিবারের এক পূর্বপুরুষ শ্রী জীবন কৃষ্ণ রায় জমিদারীর পত্তন করেছিলেন। এই গ্রামেই সমতল ছাদবিশিষ্ট এক পুজোমণ্ডপে জমিদার রায়…

Durga here takes puja in Bengali montha agrahayana

হাওড়া জেলার আমতা ব্লকের রাউতরা গ্রামে রায় পরিবারের এক পূর্বপুরুষ শ্রী জীবন কৃষ্ণ রায় জমিদারীর পত্তন করেছিলেন। এই গ্রামেই সমতল ছাদবিশিষ্ট এক পুজোমণ্ডপে জমিদার রায় পরিবার ১৩০৫ বঙ্গাব্দে কাত্যায়নী পুজো শুরু করেছিলেন। জীবন কৃষ্ণ রায়-এর সহধর্মিণী অনঙ্গ মঞ্জরীদেবীর নামানুসারে এই পুজো মণ্ডপের নামকরণ ‘অনঙ্গমঞ্জরী কাত্যায়নী পূজামণ্ডপ’ করা হয়। জীবন কৃষ্ণ রায় একবার কাশী ভ্রমণকালে কাত্যায়নী পুজো দেখে নিজের গ্রামে এই পুজো শুরু করেছিলেন। অগ্রহায়ণ মাসে দূর্গাপূজার মতো একই নিয়মে দেবী কাত্যায়নীর পুজো করা হয়।

মন্দির সংলগ্ন এক বেলগাছের তলায় ঘট পুজো করে এই পুজো শুরু হয়। বৈদিক যুগের ঋষি কাত্যায়নের কন্যা লাভের ইচ্ছে হয়েছিল। তিনি দেবী পার্বতীকে কন্যা হিসেবে পাওয়ার জন্য তপস্যা করেছিলেন। তপস্যায় তুষ্ট হয়ে দেবী পার্বতী কাত্যায়নের কন্যা রূপে জন্ম নিয়েছিলেন। তাই এই দেবীর নাম কাত্যায়নী। চতুর্ভুজা দেবী কাত্যায়নী বাহন সিংহের উপরে অবস্থান করেন। দেবীর চার হাতের মধ্যে দুই হাতে পদ্ম ও তলোয়ার ধারণ করেন এবং অন্য দুই হাত অভয় ও বরদা মুদ্রায় থাকে। যোদ্ধার দেবী নামেও দেবী কাত্যায়নী পূজিত হন।

‘‘বঙ্কিমচন্দ্রের’ অমর উপন্যাস ‘আনন্দমঠ-এ’ স্বদেশপ্রেমের যে পরিপূর্ণ চিত্র অঙ্কিত হয়েছিল, ১৯০৩ সালে ‘ঋষি অরবিন্দ’ পরিকল্পিত ‘ভবানী-মন্দির’ ছিল তার উজ্জ্বলতম প্রয়াস। কোটিব্রহ্মাণ্ডপালিনী মাতৃশক্তির আরাধনা আর মৃত্যুভয় অতিক্রম করে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কার্যকলাপ – এ দুটির প্রয়োজনীয়তাই ছিল ‘ভবানী মন্দিরের’ কল্পনার প্রধান উদ্দেশ্য। ‘ভবানী-মন্দির’ গড়ার অনুজ্ঞা ‘শ্রীঅরবিন্দ’ পেয়েছিলেন তাঁর নিজের কথায়, ‘‘সূক্ষ্মদেহী শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কাছ থেকে।’’ ‘নর্মদা’তীরে ‘গঙ্গোনাথ আশ্রমে’, কলকাতার ‘মুরারি পুকুরের বাগান’ প্রভৃতি স্থানে ও শ্রী অরবিন্দের অনুপ্রেরণায় মদীয় মধ্যম প্রপিতামহ বিপ্লব সাধক ‘দিগম্বর নন্দ বিদ্যানিধি’র উদ্যোগে বিপ্লবতীর্থ মেদিনীপুরের একাধিক জায়গায় গড়ে উঠেছিল ‘ভবানী-মন্দির’। ‘বরোদা’য় ঋষিবর অরবিন্দ স্বগৃহে দশমহাবিদ্যার অন্যতম মহাবিদ্যা ‘বগলাদেবী’র আরাধনায় দীর্ঘদিন নিয়োজিত ছিলেন। শ্রী অরবিন্দের লেখনী থেকে উৎসারিত ‘দুর্গা স্তোত্র’ আজও প্রদীপ্ত ভাস্বর হয়ে আছে। সেটির একটি অংশ হল – ‘‘মাতঃদুর্গে। সিংহবাহিনী, ত্রিশূলধারিণী, বর্মআবৃত-সুন্দর-শরীরে মাতঃ জয়দায়িনী। তোমার প্রতীক্ষায় ভারত রহিয়াছে, তোমার সেই মঙ্গলময় মূর্তি দেখিতে উৎসুক। শুন মাতঃ, ঊর বঙ্গদেশে, প্রকাশ হও।।’’

দুর্গাপূজার মঞ্চে সবাইকে সমবেত করে দেশপ্রীতি ও একতাবোধ জাগ্রত করা সম্ভব। দেশগৌরব ‘বিপিনচন্দ্র পালের’ রচনাতেও এই বক্তব্য পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল। তাঁর মতে দেবী দুর্গা হলেন উন্নত ও সুসংবদ্ধ জাতীয়তা ও সামাজিক চেতনার প্রতীক। বিবেকানন্দের অগ্নিতনয় ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র’ ভারতের ক্ষাত্রশক্তির জাগরণে মাতৃ বন্দনাকে উপজীব্য করেছিলেন। নেতাজি ছিলেন ভগবতী দুর্গার পরম ভক্ত। তাঁর লেখা সমস্ত চিঠিপত্রের শিরোনামে থাকত ‘‘শ্রীশ্রীদুর্গামাতা সহায়’’। ‘মান্দালয় জেলে’ বন্দি থাকাকালীন, ১৯২৫ সালে, এই দেশনায়কের উদ্যোগেই শুরু হয়েছিল কারাগৃহের কেন্দ্রস্থলে দেবীপূজার অনুষ্ঠান। নেতাজির চেতনায় এই আনন্দময়ীর আরাধনা ছিল দেশমাতৃকার পটভূমিকায় এক সার্থক ঐকতান।

উল্লেখ্য, সুভাষ বসুর পৈতৃক ভিটা ‘কোদালিয়া’র বসু পরিবারের শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হয়েছিল তাঁর পাঁচ পুরুষের আগে থেকেই। মা দুর্গার সেই অৰ্চনা তখন গভীরভাবে আন্দোলিত করত তরুণ সুভাষচন্দ্রকে। মাতৃআরাধনার আনন্দঘন পরিবেশ তাঁকে ভক্তি ও নিষ্ঠায় আপ্লুত করে রাখত সেই কটা দিন। এক বছর ‘কটক’ থেকে দেশের বাড়িতে পূজায় না আসতে পারায় মাতৃমহিমায় নন্দিত সুভাষচন্দ্র বসু সজল নয়নে তার গর্ভধারিণী জননীকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন – ‘‘মা এবার একটি দুঃখ রহিয়া গেল। বড় বেশি দুঃখ – সাধারণ দুঃখ নহে। এবার দেশে যাইয়া সেই ত্রৈলোক্য পূজ্যা সর্ব দুঃখহারিণী, মহিষাসুরমর্দিনী জগন্মাতা দুর্গাদেবীর সর্বাভরণভূষিতা, নানা সাজ সজ্জিতা, দেদীপ্যমানা, জ্যেতির্ময়ীমূর্তি দর্শন করিয়া নয়ন সার্থক করিতে পারিলাম না, এবার পুরোহিত মহাশয়ের সেই মধুর, পবিত্র মন্ত্রোচ্চারণ বা তাঁহার শঙ্খ ও ঘণ্টাধ্বনি কর্ণগোচর করিয়া শ্রবণ শক্তি চরিতার্থ করিতে পারিলাম না। সর্বোপরি এবার পুরোহিত প্রদত্ত শান্তি জলের অভাবে শান্তিলাভ করিতে পারিলাম না, সবই নিষ্ফল হইল।’’ মহামাতৃকার পূজায় অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত ভক্ত সুভাষচন্দ্রের অন্তর্বেদনা যে কতখানি ছিল তা স্পষ্ট।