নিউজ ডেস্ক কলকাতা: শুধু রুপোর গয়নাই নয়৷ ঘর সাজানোর বিভিন্ন জিনিসের অন্যতম সেরা ঠিকানা নিউ মার্কেটের এই দোকান। রুপোর গয়না কিংবা জাঙ্ক জুয়েলারী পছন্দ করেন, কলকাতার এমন প্রত্যেক মহিলাই কোনো না কোনো সময় ঢুঁ মেরেছেন এই দোকানে। ষাট বছর ধরে তিলোত্তমার সুন্দরীদের সাজাচ্ছে ‘চাম্বা লামা’। (Chamba Lama)
আরও পড়ুন বাংলার প্রথম অভিধান লিখতে সময় লেগেছিল ৪০ বছর
৪০-এর দশকের কোনও এক শীতে বাবার হাত ধরে দার্জিলিং থেকে কলকাতায় রুজিরুটির সন্ধানে এসেছিলেন চেতেনইয়াংজম শেরপা। দেখলেন কলকাতায় সবই আছে, কিন্তু এই তিব্বতী পরিবারের কাছে যা আছে তা শহরের কোথাও পাওয়া যায় না। কলকাতায় সেভাবে জুয়েলারি শপের ব্যবসা নেই। কারণ সেকালে কলকাতার মানুষ গয়না বলতে বুঝতেন ভারী ভারী সোনার গয়না, চাঁদি রুপো আর জড়োয়ার সেট, ম্যাক্সিমাম মিনের কাজ। কিন্তু রুপো, হোয়াইট মেটালের চাহিদা থাকলেও তা মেলার কোনও নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই। ফলে সেই বাজার ধরতে গয়না ও হস্তশিল্পের দোকান শুরু করেন চেতেনইয়াংজম।
প্রথমদিকে নিউ মার্কেটে লিন্ডসে স্ট্রিটের ফুটপাথে বসে গয়না বিক্রি করতেন তিনি। এরপর ১৯৫৭ সালে নিউ মার্কেটের ভেতর দোকান করেন, নাম দেন ‘চাম্বা লামা’। দোকানের নাম এসেছে ‘গয়া চাম্বা’ শব্দটি থেকে, যার মানে ‘মৈত্রেয়ীর বুদ্ধের পুনর্জন্ম’। নিউ মার্কেটে দোকান খোলার তিন বছর পর, অর্থাৎ ১৯৬০ সাল থেকে নিজেরাই ‘রুপোর গয়না’ তৈরি করতে শুরু করেন। বর্তমানে দোকান চালান চেতেনইয়াংজম শেরপার মেয়ে শেরিং ইয়াংকি, তাঁর ছেলে সোনম শেরপা এবং পূত্রবধূ নরকিলা শেরপা। দিনকয়েক আগেই প্রয়াত হয়েছেন দোকানের বর্তমান কর্ণধার সোনম থোন্ডুপ শেরপা।
নিউ মার্কেটে দোকান খোলার পর ষাট বছর কেটে গিয়েছে। সময়ের সঙ্গে বদলেছে গয়নার অলঙ্করণ। ক্রেতাদের চাহিদায় যুক্ত হয়েছে ‘জাঙ্ক জুয়েলারী’ও। একমাত্র ব্যতিক্রম দোকানের অন্দরসজ্জা, বাইরে থেকে দেখলে অ্যান্টিক জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে দেখে ভ্রম হতেই পারে। এবং এই বিষয়টিই বাড়িয়ে দিয়েছে দোকানের ইউএসপি। দোকানের সাজে ১৯৫০ এর নকশা ধরে রাখলেও আধুনিকতা লুকিয়ে রয়েছে তাদের গয়নার ডিজাইনে। রুপোর গয়না এবং হালের জাঙ্ক জুয়েলারীর বৈচিত্রের কারণেই বেশিরভাগ সময়েই দোকানে ঢুকতে অপেক্ষা করতে হয় ক্রেতাদের। যদিও শুধু গয়না নয়, বাড়ির অন্দরমহল সাজানোর জন্য দুর্দান্ত শো-পিস রয়েছে ‘চাম্বা লামা’র কালেকশনে।
সিটি সেন্টার ওয়ানের পরিচিত রেপ্লিকা কলকাতার ‘ঘোড়ায় টানা ট্রাম’। কামরাটি বর্তমানে চাম্বা লামার নতুন আউটলেট। কিন্ত শহর জুড়ে রুপো এবং জাঙ্ক জুয়েলারীর বহু দোকান থাকতে ‘চাম্বা লামা’র এত জনপ্রিয়তা কেন? নরকিলা শেরপার কথায়, “আমাদের গয়নার নকশাগুলো হিমালয়, নেপালি, তিব্বতী এবং কিছু উপজাতীয় শিল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত। প্রতিটি ডিজাইনেই আমরা সেই ছাপটা রাখার চেষ্টা করি। ফলে আমাদের এখানের বেশিরভাগ গয়নাতেই তিব্বতি বৌদ্ধ মোটিফ স্পষ্ট। জাঙ্ক জুয়েলারীর হিমালয়ান স্টাইল বেশিরভাগ ক্রেতাই পছন্দ করছেন। উপরন্তু শহরে পিয়ার্সিং করানোর প্রবণতা বেড়েছে, ফলে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ‘চাম্বা লামা’র ক্রেতাও।”
চাম্বা লামার গয়নার কালেকশন সম্পর্কে নরকিলা বলেন, “গ্রীষ্মে মহিলারা সাধারণত নেকলেস এড়িয়ে যান। তারা বিশাল ঝুমকা (বড় কানের দুল) বা আধা-মূল্যবান পাথরের স্টেটমেন্ট ককটেল রিং পছন্দ করেন। ফলে সেই ধরনের ককটেল রিং নিয়ে আমরা আলাদা আলাদা ডিজাইন বানাচ্ছি। এছাড়াও জাঙ্ক বা কস্টিউম গয়না সস্তা এবং রুপোর গয়নার বিকল্প। কতজন মধ্যবিত্ত মানুষ ভারী রুপোর গয়নার সেট কিনতে পারে? তাছাড়াও এখন অনেকেই রোজ ব্যবহারের জন্য জাঙ্ক জুয়েলারী বেছে নিচ্ছেন। ফলে বহুদিন হলো আমরাও আলাদা আলাদা ডিজাইনের কস্টিউম গয়না বানানো শুরু করেছি।” ক্রেতাদের কথা চিন্তা করেই চাম্বা লামার রয়েছে একটি ফেসবুক পেজও। কলকাতার এই মহিলাতান্ত্রিক ব্যবসা নিউমার্কেটের ছোট্ট পরিসরে টেনে আনছে গোটা দুনিয়াকে। শুধু সাধারণ মানুষই নন, এই দোকানে নিয়মিত আসেন সেলিব্রেটিরাও।
আরও পড়ুন ভারতের সবচেয়ে বড় পতিতালয়ের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে ঠাকুরবাড়ির নাম
অবশ্য শুধু মহিলারাই নন, পুরুষদের মধ্যেও ক্রমশ বাড়ছে জাঙ্ক জুয়ালারী, রুপোর গয়না প্রভৃতি পরার চল। যদিও রাজস্থানে অনেকদিন ধরেই রুপোর গয়না পরার প্রচলন রয়েছে পুরুষদের মধ্যে, এবং তা রীতিমতো ভারী গয়না। কর্ণধার জানালেন, কলকাতার পুরুষরা নিজেদের জন্য হালকা জুয়েলারীই পছন্দ করছেন। যদিও শুধু ব্রেসলেট নয়, নেকলেস, কানের দুল কিংবা আঙটিও কিনছেন তারা। অনেকেই আবার নিজের সঙ্গিনীর জন্য গয়নাও কিনছেন এই দোকান থেকেই, ডিজাইন বাছতে সাহায্য করছেন স্বয়ং মালকিন। কৌতুহলী ক্রেতার প্রশ্নের উত্তরে বুঝিয়েও দিচ্ছেন প্রত্যেকটি ডিজাইনের উৎস, তিব্বতী কালচারের তাৎপর্য। সবমিলিয়ে ‘নাহুমস’ এর পিছনের এই দোকান যেন কলকাতার মাঝে একটুকরো ‘হিমালয়ান কালচার’।