ভারতের সবচেয়ে বড় পতিতালয়ের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে ঠাকুরবাড়ির নাম

বাবুদের একাধিক উপপত্নী থাকাটা তখনকার সময়ের ‘বাবু কালচার’। কিন্তু ঘরে স্ত্রীয়ের সঙ্গেই বারবনিতা রাখাটা দৃষ্টিকটু। সেই সমস্যার কথা মাথায় রেখে বাবুরা তাদের উপপত্নীদের রাখার ব্যবস্থা করলেন সোনাগাছি অঞ্চলে।

Sonagachi

Kolkata24x7 Desk: প্রায় আড়াইশো কিংবা তিনশো বছর আগে শহর কলকাতায় শুরু হয়েছিল এক নতুন আভিজাত্য। যার পোশাকি নাম ‘বাবু কালচার। যদিও নবাবের আমলে ‘বাবু’ ছিল একটি বিশেষ উপাধি, নবাবের অনুমতি ছাড়া যা নামের আগে ব্যবহার করা যেত না। সাধারণত নবাবের অনুগত শিক্ষিত অভিজাত ধনীরাই এই উপাধি লাভ ব্যবহারের অনুমতি পেত। ব্রিটিশ আমলে আবার এক নতুন অভিজাত শ্রেণীর তৈরি হল। নবাব আমলের শিক্ষাকে ছাপিয়ে গেল অর্থ। অর্থাৎ ব্রিটিশ আমল থেকে বাবুর সমার্থক হয়ে উঠলো অর্থ। শিক্ষা বা বংশ পরিচয় নয়। ফলে ব্যবসা বা অন্য উপায়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে রাতারাতি বাবুর সংখ্যা বেড়ে গেল তিলোত্তমায়।

আরও পড়ুন বাংলার প্রথম অভিধান লিখতে সময় লেগেছিল ৪০ বছর

দামি গাড়ি, লক্ষ টাকার বাঈজি, পায়রা ওড়ানো, রক্ষিতাদের বাড়ি করে দেওয়া, ফি শনিবার বেশ্যাদের নিয়ে আসর বসানো, মদ খেয়ে রাতের পর রাত কাটানো ছিল এই বাবুদের প্রধান কাজ। অন্যদিকে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আসা তরুণরা বেশীরভাগই অবিবাহিত, যাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে তাদের স্ত্রী-সন্তান সুদূর ইংল্যান্ডে। এই কলকাত্তাইয়া বাবু এবং ইংল্যান্ড থেকে আসা সাদা চামড়ার তরুণ, এদের চাহিদাই গোটা একটা পতিতালয়ই গড়ে উঠল তিলোত্তমায়।

প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর

শোনা যায়, ইংরেজরা ভারতীয় অল্পবয়সী বিধবাদের ধরে আনতে লাগলেন কলকাতার সোনাগাছিতে। খুব সম্ভবত কলকাতা শহরে বেশ্যাবৃত্তির শুরু সেই সময়েই। তবে অনেক ইতিহাসবিদের মতে, পূবে কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট ও পশ্চিমে চিৎপুরের মাঝের পুরো জায়গাটা নিয়েই পতিতাদের উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। জায়গাটার মালিক ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুরদা। এই নিষিদ্ধ পল্লীর স্থাপনা হয়েছিল নাকি সেই জমিদার‘বাবু’র উদ্যোগেই। কারণ, বেশির ভাগ বাবুদের একাধিক উপপত্নী থাকাটা তখনকার সময়ের ‘বাবু কালচার’। কিন্তু ঘরে স্ত্রীয়ের সঙ্গেই বারবনিতা রাখাটা দৃষ্টিকটু। সেই সমস্যার কথা মাথায় রেখে বাবুরা তাদের উপপত্নীদের রাখার ব্যবস্থা করলেন সোনাগাছি অঞ্চলে।

Photo Essay

যদিও সেসময় সোনাগাছির এই নাম হয়নি। এবং ‘সোনাগাছি’ নামকরণের সঙ্গে ‘বেশ্যাবৃত্তি’র কোনও সম্পর্ক নেই। ইতিহাসবিদ পিটি নায়ারের বই ‘A history of Calcutta’s streets’-এর তথ্য অনুযায়ী, কলকাতা এবং সুতানটি দুই পরগনাতেই তখন বহু মুসলমানের বাস। তার মধ্যেই একজন সোনাগাজী। যার আসল নাম সোনাউল্লা শাহ চিস্তি রহমতুল্লাহ আলে। এই সোনাউল্লা ছিলেন এলাকার ত্রাস। হুগলী নদী ধরে তখন বাণিজ্য করতেন বণিকরা, তারাও ভয় করতেন এই দস্যুকে।

আরও পড়ুন বাস্তবের সিধুজ্যাঠাই ছিলেন কলকাতার শেষ বাবু

হঠাৎ তাঁর মৃত্যু হলে শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন সোনার মা। সে সময়েও সোনাউল্লার পরিচয় ছিল ডাকাত, গাজী নয়। কথিত আছে, মৃত্যুর পর একদিন তাঁর ঘর থেকে আওয়াজ পেয়ে তাঁর মা ঘরে গেলে সোনাউল্লা’কে দেখতে পান, ছেলে তাকে বলেন মৃত্যুর পর গাজী হয়েছেন তিনি। এখন থেকে ওষুধ দিয়ে মানুষের প্রাণ বাঁচাবেন। তাঁর নামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করতে আদেশ করেন। আর যে ভক্ত তাঁর দরগায় সিন্নি চড়াবে, তার উপকার হবে।

SONAGACHI BROTHEL AREA

সেই সোনাগাজীর স্মৃতিতেই কলকাতার ওই অঞ্চলে তাঁর বৃদ্ধা মা তৈরি করেছিলেন একটি মসজিদ। ‘সোনাগাজীর মসজিদ’। সোনাগাজীর কাছ থেকে ওষুধ পেতে ভিড় করতেন অন্ধ, খোঁড়া, কুষ্ঠরোগী ধনী, দরিদ্র সকলেই। বন্ধ দরজার ভিতর থেকে অদৃশ্য সোনাগাজী প্রত্যেকের জন্য ওষুধ বলে দিতে লাগলেন। কারোর ওষুধ পাওয়া গেল পুকুরের জলে, কারোর ওষুধ কোনও গাছের পাতায়। সোনাগাজীর বলা এই প্রত্যেকটি কথা একমাত্র শুনতে পেতেন তাঁর বৃদ্ধা মা। অদ্ভুতভাবে বেশিরভাগই সুস্থ হয়ে উঠতেন কয়েকদিনের মধ্যেই। ফলে সোনাগাজীর মা’র মৃত্যুর পর এই অলৌকিকতাও বন্ধ হয়ে যায়। এই ‘সোনাগাজী’ থেকেই অপভ্রংশ হয়ে জায়গার নাম হয়ে যায় ‘সোনাগাছি’।

আরও পড়ুন ‘সুলেখা কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।’, বিজ্ঞাপনে লিখেছিলেন স্বয়ং বিশ্বকবি

যদিও অনেক ইতিহাসবিদদের মতে এই ঘটনা নিছকই একটি কিংবদন্তী। তাদের মতে, সোনাউল্লা শাহ এসেছিলেন ইরান থেকে। তিনি ছিলেন একজন দরবেশ। দেশ থেকে নিয়ে এসেছিলেন প্রচুর সোনা আর টাকা পয়সা। চিৎপুর অঞ্চলে তখন কয়েক ঘর মুসলমানের বাস। সেখানে একটি পুকুরের পাড়ে মসজিদ তৈরি করেন তিনি, তাঁর মা নন। উদ্দেশ্য ছিল কলকাতা জুড়ে ইসলামের মাহাত্ম প্রচার করা। মৃত্যুর পরে সেই মসজিদের জমিতেই কবর দেওয়া হয় তাকে। যদিও এই ইতিহাসবিদদের মতে, নামটি ‘সোনাগাজী’র-ই অপভ্রংশ। সে সময় রীতিমতো ল্যান্ডমার্ক হয়ে উঠেছিল চিতপুর অঞ্চলের এই মসজিদ।

Asia biggest brothel based at Kolkata

পুরনো সেই মসজিদ ভেঙে পড়ে ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায়। এখন সেখানে চিৎপুরের পরিচিত অ্যালেন মার্কেট। যদিও মসজিদের নামেই রাস্তার নাম এখনও রয়ে গিয়েছে, মসজিদবাড়ি স্ট্রিট। বর্তমানে কলকাতার নিষিদ্ধ পল্লী হিসাবেই পরিচিত ‘সোনাগাছি’। একসময় নাকি প্যারিসের বিখ্যাত যৌনকর্মীরাও জানতেন ভারতের সবচেয়ে বড় রেড-লাইট এরিয়ার কথা।