Kaali: সাধকরা দেবী কালীকে মদ দিয়ে সাধনা করেন, মহুয়া মৈত্রের যুক্তি খাঁটি বলছে তন্ত্রসূত্র

মা কালী (Kaali) শক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবী, দশমহাবিদ্যা তন্ত্রশাস্ত্রের প্রথমস্তরের দেবী। তাঁর আশীর্বাদ এবং কৃপায় বাংলাকে পুণ্যতীর্থ করে তুলেছেন শাক্তসাধকরা। তিনি শশ্মানবাসিনী, শিবা অর্থাৎ শৃগাল, শব…

মা কালী (Kaali) শক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবী, দশমহাবিদ্যা তন্ত্রশাস্ত্রের প্রথমস্তরের দেবী। তাঁর আশীর্বাদ এবং কৃপায় বাংলাকে পুণ্যতীর্থ করে তুলেছেন শাক্তসাধকরা। তিনি শশ্মানবাসিনী, শিবা অর্থাৎ শৃগাল, শব তাঁর সহচর।

তন্ত্র শাস্ত্রানুসারে পঞ্চ ম অর্থাৎ মদ, মাংস, মুদ্রা, মৎস্য এবং মিথুন বা নারীর সঙ্গে মিলনের বিধি আছে। যদিও তার অভ্যন্তরীণ অর্থ অত্যন্ত গুঢ়। তন্ত্রশাস্ত্রে তিনভাবে সাধনার পথ বর্ণিত আছে। দিব্যভাব, পশুভাব এবং বীরভাব। পশুভাবের সাধক একবারে প্রথম এবং সর্বনিম্নস্তর। তমোগুণে আচ্ছন্ন অথচ সাধকরা মা কালীকে বলি দিয়ে, কারণ (মদ) দিয়ে সাধনা করেন।

পড়ুন: ‘কালী এমন একজন দেবী যিনি মাংস ও মদ খান’ এ মন্তব্য মহুয়ার ব্যক্তিগত: TMC

শাস্ত্রে বর্ণিত বিধি অনুসারে, এই তিনভাব আসলে সাধনার তিনস্তর। প্রথমস্তরে বা একবারে নিম্নস্তরে পশুভাব। এই পদ্ধতিতে দীর্ঘদিন সাধনার ফলে মনে বীরভাব আসে যা রজগুণের প্রতীক। তখন সাধক ভোগ, নৈবেদ্য দিয়ে পুজো দেন।

https://video.incrementxserv.com/vast?vzId=IXV533296VEH1EC0&cb=100&pageurl=https://kolkata24x7.in&width=300&height=400

তারপর আসে দিব্যভাব। যখন তিনি অন্তরের নৈবদ্য নিবেদন করেন, মন্ত্রজপই তাঁর নৈবেদ্য, আত্মবলিদানই তাঁর বলি। যেমনটা ছিল ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস, রামপ্রসাদের। অন্তরের সুধাই দিব্যভাবের সাধকের মদ।

সাধারণভাবে পশুভাব এবং বীরভাবেই সাধারণ মানুষ মা কালীর পুজো করে থাকেন। পঞ্চমুণ্ডির আসনে স্থাপিত কালীর পুজো হয় রাত ১২টার পর, উপাচারে থাকে মদ,পশুবলি দেওয়া হয়। কোনও জায়গায় তামসিক মতে পুজোর কারণে বলির মাংস রান্না করে ভোগ নিবেদন করা হয় শাস্ত্রসম্মতভাবে। ফলে স্পষ্টতই মা কালীর পুজোয় মাংস বা মদ নিবেদন করা কোনও আশাস্ত্রীয় ব্যখা নয়। রামপ্রসাদ এবং আজু গোঁসাইয়ের গানের লড়াইয়ে রামপ্রসাদ জবাব দিয়েছেন গানে “ওরে সুরা পান করি নে আমি, সুধা খাই জয় কালী বলে।”

সাধক কমলাকান্তকে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে মাকে নিবেদন করা সুরা পান করতে দেখা গিয়েছে। তাঁদের বিভুতির জোরে সেই মদের রূপ পাল্টে গিয়েছিল, যা তিনি বর্ধমানের মহারাজ তেজশ্চন্দ্রকে দেখিয়েছিলেন। এখনও বাংলার কালীমন্দিরগুলিতে (তামসিক পুজো যেখানে হয়) মদ এবং মাংস উপাচার নিবেদন করা হয়।

শ্রী শ্রী চণ্ডীর তৃতীয় অধ্যায়ের মহিসাসুরের সঙ্গে উগ্রচণ্ডারূপধারী দেবী দুর্গার লড়াইয়ের বর্ণনা আছে। সেখানে মহিসাসুরকে দেবী দুর্গা বলেছেন, “গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ় মধু যাবৎ পিবাম্যহম। ময়া ত্বয়ি হতেঽত্রৈব গর্জিষ্যন্ত্যাশু দেবতাঃ।। ” অর্থাৎ রে মূঢ়, যতক্ষণ আমি মধুপান করি, ততক্ষণ তুই গর্জন করে নে। আমি তোকে বধ করলেই দেবতারা এখানে শীঘ্রই গর্জন করবেন।” এখানে মধু শব্দের অর্থ সুরা বা কারণবারি।

তারাপীঠে মা তারাকে প্রতিদিন মাছ, বলির পাঠার মাংস, সুরা নিবেদন করা হয়। রক্তবীজের রক্তপান করে তৃপ্ত হন মা কালী বা চামুণ্ডা। চণ্ড ও মুণ্ডকে বধ করার জন্য তাঁর নাম চামুণ্ডা। চণ্ডীতে উল্লেখ করা আছে, তিনি রাজা সুরথকে বলেছেন, “যিনি পুজা, যজ্ঞ, বলি প্রদান এবং আমার মাহাত্ম্য পাঠ করেন, আমি তাঁর প্রতি তুষ্ট হই।”

লোকাচারে, হিন্দু ধর্মের দেব, দেবীরা কিন্তু আরাধ্য দেবতা নয়, তাঁরা পরিবারের আপনজন, সদস্য। দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা, এই হিন্দুদের আরাধনার সারমর্ম। আমরা যা খাই, পান করি সেটাই দেবতাকে নিবেদন করি।

দ্বিতীয় ব্যাখা, মা কালী কোনওদিনই হিন্দুদের কাছে দেবী নন, তিনি আম বাঙালির মা, সাধক কবি রামপ্রসাদের মেয়ে।

তৃতীয় ব্যাখা, দুর্গা, কালী, এরা সবাই হিন্দু ঘরের সধবা নারী। হিন্দুধর্মের প্রচলিত প্রথা অনুসারে, সধবা মহিলাকে দিনের পর দিন নিরামিষ খাওয়ালে সংসারের অকল্যাণ হয়। পুরোটাই বাঙালি লোকাচারের সঙ্গে জড়িত।

চতুর্থ ব্যাখা, গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন কে বলেছেন, ভালবেসে শ্রদ্ধা ভরে আমায় যে যা নিবেদন করে আমি এখানে আমি অর্থে শ্রীকৃষ্ণ নন,ঈশ্বর (কৃষ্ণ ও কালী অভিন্ন) সেটাই গ্রহণ করেন। ফলে কেউ যদি মাংস, মদ নিবেদন করেন ভক্তিভরে, তাতে দোষ কোথায়?

শেষের দিকে কয়েকটা কথা না বললেই নয়। ভগবান বা ঈশ্বর যাই বলুন, তিনি কিন্তু কিছুই গ্রহণ করেন না। তাঁর কাছে সবই মাটি, ধুলিকণার সমান। তিনি গ্রহণ করেন অন্তরের ভক্তি, শ্রদ্ধা, আর্তি। ফলে আমিষ নাকি নিরামিষ আপনি দেবতাকে কী নিবেদন করলেন, সেটায় ধর্ম বা সংস্কৃতি কিছুরই অপমান হয় না, শাস্ত্রমতে।

(মতামত সম্পুর্ণ লেখকের নিজস্ব। মতামতের জন্য আমরা দায়ী নই)