সংশয় ও ধোঁয়াশা (পর্ব-২)

অরুণাভ রাহারায় ‘সব কিছু কেড়ে নিতে পারো। কিন্তু আমার চোখ থেকে আর মন থেকে তুমি বিস্ময়কে কেড়ে নিয়ো না’। লিখেছিলেন জগন্নাথ বিশ্বাস। আর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়…

অরুণাভ রাহারায়

‘সব কিছু কেড়ে নিতে পারো। কিন্তু আমার চোখ থেকে আর মন থেকে তুমি বিস্ময়কে কেড়ে নিয়ো না’। লিখেছিলেন জগন্নাথ বিশ্বাস। আর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় লিখেছেন– ‘সুখ, আনন্দ, সম্পদের চেয়েও অনেক বেশি জীবনীয় উপাদন হল বিস্ময়। আর বিস্ময় আছে বলেই আমাদের সাদামাটা জীবনটা পুরোপুরি একঘেয়ে হয়ে যায় না’। কথাগুলো টের পাই গৌতম ঘোষালের গান শুনতে গিয়ে। হঠাৎ ফেসবুকের পর্দায় ভেসে এল তাঁরই গাওয়া একটা গানের ভিডিও– ‘ও কাভি মিল যায়ে তো…’ কী অপূর্ব গায়কি… আর তাতে মিশে রয়েছে ম্যাজিক-হারমোনিয়াম! কথা ও সুরের আশ্চর্য খেলা তাঁর কণ্ঠে।

   

দু-একবার এই সুর ও কথার খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছি আমি। যখন এইট-নাইনে পড়ি আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল ‘সঙ্গীত বাংলা’। লেখাপড়ায় ফাঁকি দিয়েই সারাদিন গান শুনতাম তখন। বাংলা ব্যান্ড আর অ্যালবামের গান সম্পর্কে যে ক্ষীণ ধারণাটুকু আমার হয়েছে, তা সঙ্গীত বাংলার সৌজন্যেই। অনেকের মনে আছে সেই সময় ‘ব্যান্ড-এ মাতরম’ নামে একটা প্রতিযোগিতা হত। ‘টলিউড রিপোর্টার’, ‘হাওড়া ব্রিজ’ এবং আরও কত সুন্দর সব নামের অনুষ্ঠান হত সেই চ্যানেলে। একেকটা গান দিনে দশ-বারোবার করে দেখানো হত।

গৌতম ঘোষালের ‘কুসুম কুসুম রোদ্দুর ছিল একটু আগে’ শুনেছিলাম তখনই। কী মায়া ছড়িয়ে আছে এই গানে। শুনে এখনও একই রকম ভাল লাগে। আর বুঝতে পারি এ গানের সঙ্গে আমার কিশোরবেলা কতটা জড়িয়ে আছে! গানের ভিডিওটাও ঘটনাবহুল। তখন তো আর ইউটিউবের রমরমা ছিল না। তাই এ গান কখন দেখানো হবে তার জন্য টিভির সামনে বসে অপেক্ষা করতে হত। গান জুড়ে প্রেম আর বিরহের রৌদ্রছায়া।

শিল্পী গৌতম ঘোষালের সঙ্গে ভাগ্যক্রমে দেখা হয়ে যায় সেই সময়! ২০০৭ সালে, আলিপুরদুয়ার ডুয়ার্স উৎসবে তিনি গান গাইতে এসেছিলেন। আমি যথারীতি টিউশন ফাঁকি মেরে সন্ধের আগেই পৌঁছে যাই প্যারেড গ্রাউন্ডে। ডিসেম্বরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় গ্রিনরুমের পর্দাটা দুলে উঠল একবার। দূর থেকে দেখতে পেলাম ভেতরে তিনি বসে আছেন সোফায়। ঘিয়ে রঙের একটা জ্যাকেট আর মাথায় তাঁর স্বভাবসিদ্ধ টুপি! আমি গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম এবং অটোগ্রাফের খাতাটা বাড়িয়ে দিলাম। খসখস করে পাঁচ লাইনের শুভেচ্ছা লিখে দিলেন গৌতম ঘোষাল। যা আমি সংগ্রহে রেখেছি এখনও। মন ভারি হয়েছিল সেদিন এই কারণে যে, বহু শিল্পীর সমাবেশর চাপে মাত্র কুড়ি মিনিট গান গেয়েছিলেন তিনি! অবশ্য স্বস্তির ব্যাপার তিন-চারটে গানের মধ্যে আমার প্রিয় গানও ছিল।

মাঝে দশ বছর কেটে গিয়েছে। ততদিনে আমি গান থেকে চলে গিয়েছি দূরে। একদিন ভোরবেলায় লিখতে বসার আগে দেখলাম শিল্পীবন্ধু নম্রতা ভট্টাচার্য ফেসবুকে একটা ছবি পোস্ট করেছেন তার গুরুজি গৌতম ঘোষালের সঙ্গে। মনে আছে আগের দিনই গুরু পূর্ণিমা ছিল। নম্রতার নানা গান শুনেছি, তবে সে যে গৌতমদার ছাত্রী সে কথা আগে জানতাম না। সেই ছবিতে গুরু এবং ছাত্রী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন, একটু বয়স বেড়েছে গৌতম ঘোষালের। দেখা মাত্রই ভেতরে কাজ করল নস্ট্যালজিয়া। ডুব দিলাম কৈশোরে। এই ভালটুকুর জন্য নম্রতাকে আজও ধন্যবাদ। হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তেকে সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিল নম্রতা।

নম্বর জোগাড় করে একদিন ফোন করলাম গৌতম ঘোষালকে। ওপরে যা লিখেছি তারই মধ্যে বললাম কিছু কিছু। দশ বছর আগে নেওয়া সেই অটোগ্রাফের পৃষ্ঠাটা ছবি তুলে পাঠিয়ে দিলাম হোয়াটসঅ্যাপে! সেই ছবি দেখে গৌতমদা নিজেই বিস্মিত! ২০১৭ সালে মুকুন্দপুরে শিল্পীর বাড়িতে যেতে হল অ্যাসাইনমেন্টে। তখন একটি ওয়েব পত্রিকা সম্পাদনা করতাম। তারই জন্য ইন্টারভিউ নিতে যাওয়া। সময়ও দিলেন তিনি। বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যতে দেখতে পেলাম কত সবুজ গাছপালা। আগের দিন বৃষ্টি হয়েছে বোধ হয়! চারদিকে বড় বেশি সবুজ ছড়িয়ে আছে। যেন আমার কিশোরবেলা চারদিকে এসে দাঁড়িয়েছে! ঘিরে ধরছে আমাকেই। বাড়ির কাছে একটা পুকুর, তার ধারে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। বহু বছর আগে খোলটালার দিকে সাইকেল চালানোর সময় ‘কুসুম কুসুম’ গুনগুন করতাম, মনে পড়ল সেকথাও। তারপর গৌতমদার গানের ঘরে গিয়ে মুখোমুখি বসে পড়লাম কার্পেটের ওপরে। আমাদের মাঝখানে শুধু একটা হারমোনিয়াম। এভাবে কোনও দিন তাঁর কাছাকাছি বসতে পারব– সত্যিই আগে ভাবিনি। কথা বলতে গিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে কি সুন্দর বুঝিয়ে দেন তিনি! কত কথা হল সেদিন। গানের কথায় ভরিয়ে দিলেন আমার মন। ইন্টারভিউয়ের চেয়ে আড্ডাই হল বেশি।

তাঁর কথায় উঠে এসেছিল মান্না দে-র সঙ্গে দেখা হওয়ার স্মৃতি: “তখন আমার অল্প বয়স। গলা ঘোরে খুব। দক্ষতা প্রমাণ করার প্রবণতা ছিল! আর রাগাশ্রয়ী গানে গলা ঘোরানোর সুযোগও বেশি। মান্না দে আমাকে বলেছিলেন– গলার কাজ একটু কমাতে হবে। আরেকটু সোজা ভাবে গাইবে। তাহলে মানুষের ভালো লাগবে।” গৌতম ঘোষাল আজও আমার হৃদয়ে-ঘরে মিশে আছেন। ছোটবেলায় তাঁর গান শুনে যে বুক দুরুদুরু ব্যাপারটা তৈরি হয়েছিল, সেই প্রত্যক্ষ অনুভূতিকে আমি অবিশ্বাস করি কী করে? লিখতে গেলে কতই স্মৃতি ফিরে আসে। পরেও যখন তাঁর সঙ্গে বিক্ষিপ্ত কথা হয়েছে ফোনে, তিনি এই অধমকে বলেছিলেন– ‘তোমাকে ভাল লেগেছে। কাছেই তো থাকো। মাঝেমধ্যে চলে এসো বাড়িতে।’ তাঁর কাছ থেকে এ কথা শোনা কি প্রাপ্তি নয়? কিন্তু হায়! জীবনের টানে আর পেশার টানে ব্যস্ততায় মিশে গিয়ে আর কখনও যাওয়াই হয়নি। এ কথা মনে করে আজ খুব খারাপই লাগছে আর অন্যায় বোধ হচ্ছে।

তিনি সেদিন সদ্য বেরনো গানের অ্যালবাম ‘মজলিস’ উপহার দিয়েছিলেন আমাকে। ওইটুকু পরিচয়ে এমন উপহার! আমি আদৌ কি তার যোগ্য? ভালবাসাটাই বোধ হয় প্রশ্রয় পেয়েছিল সেদিন। আর আমি বুঝতে পেরেছিলাম কতটা বড় তাঁর মন। সেই থেকে এখনও মজলিসের গানগুলো শুনে চলি…। আটখানা বৈঠকি মেজাজের গান রয়েছে এই অ্যালবামে। একটি গানের নাম ‘তোমার কথা ভেবে’। সেই গানে পাই এমন লাইন: ‘বিকেল হলে এলোচুলে আজও কি দাঁড়াও, ছাদের কিনারায়’? শুনেই আমার মনে পড়ে ক্লাস নাইনে দেখা একটা ন্যাড়া ছাদের দৃশ্য! যেখানে সত্যিই একটি মেয়ে এলোচুলে দাঁড়িয়ে থাকত রোজ বিকেলবেলায়, ছাদের তারে নিজের হাতের ওপর চিবুক রেখে। পাশের রাস্তা দিয়ে আমি সাইকেল চালিয়ে পড়তে যেতাম আর চোখ ভরে দেখতাম এই মায়াবী ছবি। সেই মেয়েটির নামই বিস্ময়! আজ, এ লেখার মধ্যে দিয়ে মেয়েটিকে প্রশ্ন করতে চাই, বিকেল হলে ছাদের ধারে আজও কি দাঁড়াও? আমার জন্য? গান কি এভাবেই মিশে যায় জীবনের সঙ্গে? মেয়েটির সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে কিনা জানি না তবে একটু জানি, পৃথিবীতে সুসময় এলে প্রিয় শিল্পী গৌতম ঘোষালের সঙ্গে দেখা হবে আবার।