বলাগড়ের তৃণমূল বিধায়ক মনোরঞ্জন ব্যাপারি (Manoranjan Byapari) ফের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। শনিবার নিজের ফেসবুক পোস্টে তিনি ক্ষোভ উগরে দিয়ে জানান, আগামী ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁকে দলীয় টিকিট দেওয়া হবে না বলে যেভাবে গুজব ছড়ানো হচ্ছে, তাতে তিনি মর্মাহত। সেইসঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের পাশাপাশি দলীয় মহলের কিছু অংশকেও আক্রমণ করতে ছাড়লেন না।
মনোরঞ্জনবাবুর ভাষায়, “আমি ফেসবুকে কিছু লিখলেই মূল বক্তব্য থেকে সরে এসে অনেকে আমার ওপর ব্যক্তিগত আক্রমণ শুরু করে দেন। বলে—‘আপনি যা-ই লিখুন, ২৬শের টিকিট আর পাচ্ছেন না।’ এমনকি বলাগড়েরই এক তৃণমূল কর্মী প্রথম এই কথাটা লেখে। পরে নানা সিকি আধুলি, খুচরো পয়সাও বলতে শুরু করেছে—আমি নাকি আর টিকিট পাচ্ছি না।”
এখানেই থামেননি তিনি। ইউটিউবে প্রকাশিত একটি ভিডিওর প্রসঙ্গ টেনে মনোরঞ্জন ব্যাপারি বলেন, “সেখানে নাকি নির্ভরযোগ্য সূত্রে সংবাদ এসেছে—৩৫ জন তৃণমূল বিধায়ক আর টিকিট পাবেন না, সেই তালিকায় আমার নামও রয়েছে। প্রশ্ন হল, আমি যদি টিকিট না-ই পাই, তবে এত উল্লাস কেন?”
ক্ষোভের বিস্ফোরণ
নিজেকে ঘিরে টিকিট নিয়ে এমন জল্পনার কারণ জানতে চেয়ে সোজাসাপ্টা ভাষায় মনোরঞ্জন বলেন, “আমি কি মাটি চোর? বালি চোর? রেশন পাচার করি? গরু পাচারের সঙ্গে জড়িত? আমি কি সবুজ দ্বীপের গাছ কেটে পাচার করি? পারবে কেউ বলতে? আমি কি কোনও অন্যায় কাজে যুক্ত?” তিনি দাবি করেন, বরং গত সাড়ে চার বছরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব অবৈধ কাজের বিরোধিতা করেছেন। “যে কারণে বলাগড়ের মানুষ রাস্তায় আমাকে দেখলে বলে ওঠে—‘ফাটাকেষ্ট যাচ্ছে।’” তাঁর বক্তব্য, এটি জনগণের প্রশংসা না কি নিন্দা? আর যদি মানুষের সমর্থন থাকে, তবে দল তাঁকে টিকিট দেবে না কেন—সেই প্রশ্নই তুলেছেন বিধায়ক।

রাজনীতি তাঁর কাছে পেশা নয়
মনোরঞ্জন ব্যাপারি আরও স্পষ্ট করেন, রাজনীতি তাঁর কাছে পেশা নয়, রোজগারের মাধ্যমও নয়। “আমার করার মতো অন্য কাজ আছে, যে কাজের জন্য গোটা ভারত আমাকে চেনে। টিকিট পেলাম কি পেলাম না, আমি পরোয়া করি না,”—লিখেছেন তিনি।
তাঁর কথায়, ২০২১ সালের ভোটেও তিনি প্রার্থী হতে চাননি। কিন্তু পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে তাঁকে দাঁড়াতেই হয়েছিল। কারণ, বিজেপির আক্রমণাত্মক প্রচার এবং সিপিএমের ‘২১-এ রাম, ছাব্বিশে বাম’ স্লোগান দেখে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন—বাংলার সংস্কৃতি, সাহিত্য, ভাষা সব ধ্বংস হয়ে যাবে। এমনকি তাঁকে আবার দণ্ডকারণ্যের জঙ্গলে ফিরে যেতে হবে। সেই ভয় থেকেই তিনি রাজনীতির ময়দানে নামেন।
তৃণমূলের বিপদে এগিয়ে আসা
মনোরঞ্জন জানান, প্রার্থী হতে গিয়ে তাঁকে নিজের সরকারি চাকরিটা ছাড়তে হয়েছিল। “যদি ভোটে হেরে যেতাম, জানি না আজ আমি কোথায় থাকতাম। কিন্তু মনে ভেবেছিলাম, দিদি জিতলে আমাকে অন্তত না খেয়ে মরতে দেবেন না।” শেষ পর্যন্ত বলাগড়ের আসনে তৃণমূল তাঁকে প্রার্থী করে এবং তিনি বিজেপির শক্ত ঘাঁটি থেকে জয় ছিনিয়ে আনেন।
তাঁর দাবি, “সেই সময় তৃণমূল দলের চরম বিপদের দিন ছিল। আজ আর তা নেই। আজ তৃণমূল প্রার্থী হলে আশিভাগ ভোট দিদির নামেই আসবে, বাকি কুড়িভাগ প্রার্থী নিজে সংগ্রহ করতে পারলেই সহজে জিতে যাবে।”
বিজেপিকে তুলোধোনা
ফেসবুক পোস্টে মনোরঞ্জন ব্যাপারি বিজেপির বিরুদ্ধে তোপ দাগতে ছাড়েননি। তাঁর মতে, বিজেপি বাংলার সমাজ-সংস্কৃতি ধ্বংস করে দেবে। তিনি লেখেন, “নাচোন-কোদোন করা মূর্খগুলো জানে না বিজেপি ক্ষমতায় এলে বাংলার কী সর্বনাশ হবে।”
তিনি জানান, বাংলার ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজজীবন সব মুছে যাবে। বাংলাকে বিজেপি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে। সেই ভয় থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন।
ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা নেই
মনোরঞ্জন ব্যাপারি স্পষ্ট জানিয়েছেন, তিনি আবার টিকিট পান বা না পান—তাতে বিশেষ কিছু এসে যায় না। তাঁর নিজের অন্য কাজ রয়েছে, যেগুলির প্রতি তিনি মনোযোগী হতে পারবেন। বিধায়ক পদ হারালে হতাশ হবেন না বলেই দাবি করেছেন তিনি।
তিনি লিখেছেন, “তৃণমূলকে আগামী তিনটে নির্বাচনে হারাতে পারে এমন কোনও দল বাংলায় নেই। তাই আমি টিকিট পাই বা না পাই, তাতে কিছু আসে যায় না।”
রাজনৈতিক মহলে জল্পনা
তাঁর এই পোস্টকে ঘিরে রাজনৈতিক মহলে শুরু হয়েছে তীব্র জল্পনা। অনেকের মতে, মনোরঞ্জন ব্যাপারীর আক্রমণাত্মক ভঙ্গি ইঙ্গিত দিচ্ছে—দলের ভেতরে তাঁকে নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে। অন্যদিকে, অনেকে মনে করছেন, এটি তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
তবে একথা স্পষ্ট, বলাগড়ের বিধায়কের এই বিস্ফোরক ফেসবুক পোস্ট আবারও রাজ্য রাজনীতিতে চর্চার কেন্দ্রে এনেছে তাঁকে। তিনি টিকিট পান কি না, তা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু তাঁর ক্ষোভ-ভরা বক্তব্যে দলীয় নেতৃত্বকেও নিঃসন্দেহে অস্বস্তিতে ফেলেছে।