শবনম-সাবিত্রীদের নিয়ে সরস্বতী পুজো করান এই প্রধান শিক্ষক

পুজোর সঙ্গে ধর্ম জড়িয়ে। তাই স্কুল-কলেজে সরস্বতী পুজো (Saraswati Puja) করা যাবে না। এমনই হুমকির অভিযোগ। শিক্ষাঙ্গনে সরস্বতী পুজো নিয়ে বিতর্ক। কলকাতার কলেজ থেকে নদিয়ার…

Headmaster Sayantan Das Leads Inclusive Celebration with Shabnam and Sabitri Despite Religious Opposition

পুজোর সঙ্গে ধর্ম জড়িয়ে। তাই স্কুল-কলেজে সরস্বতী পুজো (Saraswati Puja) করা যাবে না। এমনই হুমকির অভিযোগ। শিক্ষাঙ্গনে সরস্বতী পুজো নিয়ে বিতর্ক। কলকাতার কলেজ থেকে নদিয়ার প্রাইমারি স্কুল। এই নদিয়াতেই শবনম-সাবিত্রীদের নিয়ে সরস্বতী পুজো করেন এক প্রধান শিক্ষক। সেটাও মৌলবাদীদের সঙ্গে লড়াই করে।

সালটা ২০১৭। সেই বছরেও সরস্বতী পুজো ছিল ফেব্রুয়ারির শুরুতে। নদিয়ার তেহট্টের গোপীনাথপুর নেতাজি বিদ্যামন্দির উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তখন সায়ন্তন দাস। এলাকার ৭৫ শতাংশ বাসিন্দা অহিন্দু। স্কুলে সরস্বতী পুজোতে তাঁদের আপত্তি। স্কুলের মধ্যে পুজো নাকি ধর্মনিরপেক্ষতার পরিপন্থী। ধর্মের দোহাই দিয়ে কার্যত হুমকি।

   

মৌলবাদীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অবস্থানে অটল ছিলেন প্রধান শিক্ষক সায়ন্তন দাস। তবে বিবাদে জড়াননি। স্কুলে সরস্বতী পুজো করেছিলেন। স্কুলের সেই পুজোয় একসঙ্গে অঞ্জলি দিয়েছিল শবনম-সাবিত্রীরা। পুজোর আয়োজনও তারাই করেছিল। দুপুরের খাওয়াদাওয়াও একসঙ্গেই করেছিল সাবির-সমীররা। স্কুলে ধর্মের বিভেদ ঘুঁচিয়ে সেদিন প্রধান শিক্ষক সায়ন্তন দাস বলেছিলেন, “তেহট্টের ট্রপোস্ফিয়ারে এই চারাগাছগুলো বেশ খানিকটা অক্সিজেন ভরে দিল। আমাদের সবার সন্তান ভালো নম্বরের কর বলে পড়ার আগে ভালো করে বাঁচতে শিখুক।”

Saraswati Puja Controversy

পদার্থবিদ্যার সেই শিক্ষক নদিয়া থেকে এখন কলকাতায়। মিত্র ইনস্টিটিউশন মেন-এর প্রধান শিক্ষক। এখনকার স্কুল-কলেজে সরস্বতী পুজো নিয়ে বিতর্কে তাঁর মন ভার। বললেন, “আবার সরস্বতী পুজোকে কেন্দ্র করে একটা অন্যরকম মৌলবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ, সন্ত্রাস, ধ্বংস, নষ্টামি, যেভাবেই ভাবা যাক তা ঘটে চলেছে। এমন নয় যে এটা নতুন করে শুরু হয়েছে, বরং এই চেষ্টা গত বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে।”

তিনি আরও বলেন, “বিদ্যালয় শিক্ষার সাথে যেমন রবীন্দ্র জয়ন্তী যুক্ত ছিল,তেমনি আমরা ছোট থেকেই দেখে এসেছি বিদ্যালয়ের নানারকম সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলী যার মাধ্যমে সুকুমারমতি শিক্ষার্থীদের মানসিক, প্রাক্ষভিক ও সামাজিক বিকাশ সম্পন্ন হয় তার মধ্যে সরস্বতী পুজোও অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত ছিল।আমরা যখন পড়াশোনা করেছি তখন কেউ দেখতে যাইনি আমার পাশের বন্ধুটির নাম গৌড়হরি না জোসেফ জয়ন্ত নাকি মহম্মদ আসিফ।বন্ধুত্বই ছিল আমাদের মধ্যে একমাত্র বিচার্য বিষয়। কারণ আমাদের অভিভাবকরা মনে করতেন এবং সঠিক ভাবেই মনে করতেন যে এই পুজোও কোনোভাবেই শুধু হিন্দুদের অনুষ্ঠান নয়। সরস্বতী পুজো একটা বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠান।সেখানে সরস্বতী দেবীর মূর্তির পুজো আসলে গোটা বিদ্যালয় এবং লেখাপড়ার উন্মুক্ত পরিবেশকেই পুজো করা।”

শুধু নদিয়ার তেহট্ট নয়, হাওড়া জেলার তেহট্টেও সে বছর শোরগোল হয় সরস্বতী পুজো নিয়ে। পুজো বন্ধের হুমকি দেন মৌলবাদী নেতা। স্কুলে ঢুকে তাণ্ডব চালানো হয় বলেও অভিযোগ। আতঙ্কে প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন হাওড়ার তেহট্ট হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক উৎপল মল্লিক। স্কুলে সরস্বতী পুজোর দাবিতে পথে নামে পড়ুয়ারা। জাতীয় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখায় পড়ুয়ারা। পুলিশের লাঠিতে এক ছাত্রীর মাথা ফাটে।

২০১৮ সালে শাসকদলের স্থানীয় প্রতিনিধিরা তেহট্ট হাইস্কুলের সরস্বতী পুজোর পাশে দাঁড়ান। তখন থেকে প্রতি বছর সরস্বতী পুজো হচ্ছে তেহট্ট হাইস্কুলে। এখনও ওই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক উৎপল মল্লিক। তাঁর মতে, “একটা ভয়াবহ সময় পার করেছি। প্রকাশ্য সভা থেকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। অনেক লড়াই করে সে সব কাটিয়েছি। ২০১৮ সালেও স্কুলের সরস্বতী পুজো নিয়ে চাপা উত্তেজনা ছিল। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক।”

২০১৭ থেকে ২০২৫। অনেক বদলে গিয়েছে পৃথিবী। বাংলার সমাজ এবং রাজনীতিও এখন অনেকটাই আলাদা। স্কুল-কলেজে সরস্বতী পুজো নিয়ে বিতর্কের খবর নিয়ে মিডিয়া সরগরম। বিতর্কের জল গড়ায় কলকাতা হাইকোর্টে। আদালতের নির্দেশে পুজো হচ্ছে। সরস্বতী পুজোর সময় শিক্ষাঙ্গনে নিরাপত্তার নির্দেশও দিয়েছে হাইকোর্ট।