আরজিকর (RGkar) হাসপাতালের চিকিৎসক হত্যাকাণ্ডের তদন্তে এক নতুন নাটকীয় মোড় নিল। শিয়ালদা আদালতে আজ এই মামলার শুনানিতে সিবিআই-এর (CBI) আইনজীবী (Lawyer) এক লাইনে জানান, “সাপ্লিমেন্টারি (Supplementary) চার্জশিট (Charge Sheet) দিতে পারছিনা।” এই বক্তব্যের পরই আদালত অভিযুক্তদের জামিন মঞ্জুর করে। অভিযোগের কেন্দ্রে থাকা সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার প্রাক্তন ওসি অভিজিৎ মন্ডল, যাদের গ্রেফতারের ৯০ দিন হল আজ, তাদের বিরুদ্ধে সিবিআই চার্জশিট জমা দিতে না পারায় আদালত জামিন প্রদান করে। এই ঘটনা রাজ্যজুড়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি সিবিআই-এর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে।
শিয়ালদা আদালতে সিবিআই-এর আইনজীবী যখন এক লাইনে এই বক্তব্য দেন, তখন উপস্থিত সকলেই অবাক হয়েছে। যখন শোনা যাচ্ছিল সিবিআই-এর পক্ষ থেকে নানা অভিযোগ এবং প্রমাণের ভিত্তিতে মামলা চলবে। তবে আইনজীবী যখন দাবি করেন, তারা চার্জশিট জমা দিতে পারছেন না, তখন অনেকেরই মনে প্রশ্ন উঠেছে, কেন এতদিনে সিবিআই এর তদন্ত শেষ করতে পারল না? শুধু তাই নয় সুপ্রিম কোর্টেও সিবিআই-এর তরফ থেকে আইনজীবীরা তথ্য-প্রমাণ লোপাট, ৯০০ ঘন্টার ভিডিও ফুটেজ এই সকল তথ্য তুলে ধরছিল।
গত কয়েক মাস ধরে, আরজিকর হাসপাতাল হত্যাকাণ্ডের তদন্তে সিবিআই-এর দাবি ছিল যে, তথ্য-প্রমাণ লোপাট করা হয়েছে এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তারা আদালতে তুলে ধরেছেন। কিন্তু ৯০ দিন পরে, এক লাইনে এই বক্তব্য চূড়ান্ত হতাশাজনক বলে মনে হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে যে, সিবিআই-এর কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে এবং তাদের কার্যক্রমের মধ্যেই কোনও অস্বচ্ছতা থাকতে পারে।
যতটা সময় পেরিয়ে গেল, ততই মামলা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা শুরু হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে শোনা যাচ্ছিল যে, সিবিআই তদন্তে অনেকগুলি জটিলতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, তালা থানার সিসিটিভি ফুটেজ এবং প্রথম তথ্য রিপোর্ট (এফআইআর) জমা দিতে দেরি হওয়ার মতো কিছু বিষয় আলোচনায় এসেছিল। কিন্তু আজ আদালতে সিবিআই-এর পক্ষ থেকে কোনও ব্যাখ্যা না দিয়ে, এমনভাবে মন্তব্য করা সকলকে বিস্মিত করেছে।
এই ঘটনায় সিপিএম নেতা শতরূপ ঘোষ স্পষ্ট দাবি করেছেন যে, এই ঘটনার পিছনে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির হাত রয়েছে। তাঁর বক্তব্য, রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে কিছু শক্তি চেষ্টা করছে এই তদন্তকে ধামাচাপা দেওয়ার। তিনি আরও বলেন, যে ভাবে সিবিআই এর তদন্ত এগিয়েছে, তাতে প্রমাণিত হচ্ছে যে, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা আসলে রাজনৈতিক চাপের সামনে মাথা নত করেছে। সিপিএম নেতা এই ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বলেন, “এটা এক চক্রান্তের ফল, যাতে নির্দোষরা মুক্তি পায় এবং অপরাধীরা ফাঁসির বদলে জামিন পেয়ে যান।”
এই ঘটনার পর, নির্যাতিতার বাবা-মা কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং তাঁদের মনে প্রশ্ন ওঠে, ‘‘সত্যিই কি আমাদের সঠিক বিচার হবে?’’ তাঁরা সিবিআই ও আদালতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তারা বলছেন, ‘‘যদি তথ্য-প্রমাণ থাকতো, তাহলে এতদিনে কেন চার্জশিট জমা দেওয়া হয়নি? এর মানে কী যে, সঠিক বিচার পাওয়া যাবে না?’’ তাঁরা বলেন, ‘‘আমরা কেন এমন সমাজে বাস করছি, যেখানে অপরাধীরা এত সহজেই মুক্তি পেয়ে যায়?’’
চিকিৎসক মহলও এই ঘটনায় হতাশা প্রকাশ করেছে। তারা বলছেন, চিকিৎসকদের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার জন্য সরকার এবং প্রশাসন আরও কঠোর পদক্ষেপ নেবে, এই আশা তারা আর রাখতে পারছেন না। চিকিৎসকরা মনে করেন, যখন এমন গুরুত্বপূর্ণ মামলায় সিবিআই-এর মতো প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা এইরকম সন্দেহজনক হবে, তখন সাধারণ মানুষ এবং বিশেষ করে চিকিৎসকরা নিরাপদে থাকবেন কীভাবে?
এছাড়া, নাগরিক সমাজের সদস্যরাও এই ঘটনার পর দুঃখ প্রকাশ করেছে। তারা বলছেন, ‘‘এটা শুধু চিকিৎসক সম্প্রদায়ের বিষয় নয়, গোটা সমাজের সমস্যা।’’ মানুষের নিরাপত্তা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সরকারের উচিত কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ‘‘সরকার কি তাদের দায়িত্ব পালন করবে?’’ এই প্রশ্ন তুলেছেন নাগরিক সমাজের সদস্যরা।
এই পরিস্থিতিতে, একটি বড় প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে — সিবিআই-এর ভূমিকা কি একেবারে নিরপেক্ষ ছিল? কেন তারা এতদিনেও চার্জশিট জমা দিতে পারল না, যখন প্রমাণ এবং তথ্য তারা দাবি করেছিল যে, তাদের হাতে রয়েছে? এমন একটি সুরাহা না হওয়া তদন্ত সাধারণ মানুষের মনে সরকারের প্রতি অনাস্থা তৈরি করবে। আদালতের জামিন মঞ্জুর করা এবং সিবিআই-এর অবহেলা, এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যেখানে সাধারণ মানুষের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার বিশ্বাস প্রশ্নের মুখে পড়েছে। শুধু তাই নয় জুনিয়র চিকিৎসক মহলের তরফে জানানো হয়েছে আবারও তারা রাজপথে নামবে আন্দোলনের শামিল হবেন। সিবিআই এর ভূমিকা নিয়ে তীব্র ভাষায় ধিক্কার জানান আন্দোলনকারী চিকিৎসক অনিকেত মাহাতো।
এখন রাজ্যের প্রশাসনিক মহল এবং নাগরিক সমাজের কাছে প্রশ্ন? সঠিক তদন্ত এবং ন্যায়বিচারের জন্য সরকার কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে? আরজিকর কাণ্ডের মতো ঘটনা যদি একে একে ধামাচাপা দেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করা কিভাবে সম্ভব হবে?