লক্ষ্যভেদের ক্ষমতা হারিয়ে উপনির্বাচনেও বিজেপির বাতিলের খাতায় অর্জুন?

অর্জুন সিং… নামটা শুনলেই একটা জায়গার কথাই মাথায় আসে ব্যারাকপুর। বাম আমলে সিপিআইএমের দোর্দন্ডপ্রতাপ তড়িৎ বরণ তোপদারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়াই করে নিজেকে কার্যত মিথে…

Arjun Singh's Exclusion from BJP's By-Election Candidate List

অর্জুন সিং… নামটা শুনলেই একটা জায়গার কথাই মাথায় আসে ব্যারাকপুর। বাম আমলে সিপিআইএমের দোর্দন্ডপ্রতাপ তড়িৎ বরণ তোপদারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়াই করে নিজেকে কার্যত মিথে পরিণত করেছিলেন তৃণমূলের অর্জুন (Arjun Singh)। ২০১১ এর ক্ষমতার পালাবদলের পর গঙ্গাতীরের গোটা ব্যারাকপুর অঞ্চলে কার্যতো বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত অর্জুনের নামে। তথাকথিত শিল্পাঞ্চল এবং অবাঙালি অধ্যুষিত ব্যারাকপুরের বিভিন্ন এলাকাতে কার্যত মসীহাতে পরিণত হয়েছিলেন অর্জুন।

চলছিল সবই ভালই। কিন্তু কথায় বলে রাজনীতির দাবা খেলায় একটা ভুল চাল অতি বড় রাজাকেও ফকির বানিয়ে দিতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে অর্জুনের ক্ষেত্রেও কার্যত সেটাই হলো। তবে একবার নয় দু দুবার তিনি একই ভুল করলেন এমনটাই মনে করেন অনেকে।

   

বাম আমলে ২০০১ সাল থেকে শুরু করে ২০১৯ সাল অবধি ছিলেন বিধায়ক। ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সাল অব্দি ছিলেন ভাটপাড়া পৌরসভার চেয়ারম্যানও। কিন্তু সব ছেড়েছুড়ে ২০১৯ সালে যোগদান করলেন বিজেপিতে। নেপথ্যের কারণ হিসেবে বলা হয় ব্যারাকপুরের তৎকালীন এমপি দীনেশ ত্রিবেদীর সঙ্গে মতানৈক্য এবং লোকসভায় টিকিট পাওয়ার প্রবল বাসনা। অবশ্য ২০১৯ সালে রাজ্যে বিজেপির হওয়াতে ব্যারাকপুরে গেরুয়া পতাকা ওড়াতে সফল হন অর্জুন। প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই লক্ষ্যভেদ করে পৌঁছে যান লোকসভাতে।

তারপরই ভাটপাড়া জুড়ে সেই তীব্র অশান্তি। অভিযোগের তীর অর্জুন অনুগামীদের বিরুদ্ধে। এমনকি গঙ্গার ওপার থেকে ভাড়া করে আনা গুন্ডাদের তাণ্ডবে কার্যত বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয় ব্যারাকপুরের ভাটপাড়ার বিস্তীর্ণ অংশ। পরিস্থিতি সামলাতে সে সময় মমতা ব্যানার্জি ব্যারাকপুরে পাঠান দুদে আইপিএস মনোজ ভার্মাকে। ঘটনাচক্রে যিনি বর্তমানে কলকাতার পুলিশ কমিশনার। শেষমেষ অশান্ত ভাটপাড়ায় অশান্তির জোয়ারে ভাটা এনে মুখ্যমন্ত্রীর থেকে বিশেষ পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিনি।

এদিকে ২০২১-এর নির্বাচনে ব্যারাকপুরের রাজ চক্রবর্তী, শ্যামনগরের সোমনাথ শ্যাম, নৈহাটির পার্থ ভৌমিক এবং বীজপুরের সুবোধ অধিকারী, এই চারজনের ধাক্কাতে কার্যত ভেঙে পড়ল অর্জুনের গড়। একমাত্র নিজের ছেলে পবন সিংকে ভাটপাড়া থেকে জেতানো গেল।বাকি সব জায়গাতেই বিজেপির পদ্মবনকে ছারখার হওয়া থেকে আটকাতে পারলেন না অর্জুন।

অবস্থা বেগতিক দেখে, বিধানসভা নির্বাচনের মাস খানেক পরেই, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক ব্যানার্জির দ্বারস্থ হন অর্জুন। অভিষেকের হাত ধরেই অর্জুন ফিরলেন তার পুরোনো দলে। কিন্তু রাজনৈতিক জীবনে শান্তি ফিরলো না। বিশেষ করে শ্যামনগরের সোমনাথের সাথে অর্জুনের বিবাদ ক্রমশ বেড়েই চলল। ২৪ এর লোকসভার আগে যা কার্যত প্রতিদিনই খবরের কাগজের হেডলাইনে পরিণত হল। তবুও অর্জুন আশা রেখেছিলেন যে ২০২৪-এ হয়তো এমপি টিকিট তৃণমূলের তরফ থেকে তার কপালেই জুটবে।

কিন্তু ব্রিগেডের মাঠে চমক দেওয়ার ৱ্যাম্প ওয়ার্কের প্রার্থী তালিকা ঘোষণায় অপ্রত্যাশিতভাবেই ছিলনা অর্জুনের নাম। ব্রিগেডের মাঠে বসেই মুখ কালো হয়ে যাওয়া অর্জুনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। দিন কয়েকের মধ্যেই নিজের অফিসে মমতা ব্যানার্জির ছবি সরিয়ে ফিরে এল আবারও নরেন্দ্র মোদির ছবি। তড়িঘড়ি দিল্লিতে গিয়ে আবারও বিজেপিতে যোগদান এবং প্রত্যাশিতভাবেই টিকিট পাওয়া। কিন্তু এই যাত্রায় গড় রক্ষা হলো না। নৈহাটি বিধায়ক, রাজ্যের সেচ মন্ত্রী তৃণমূলের হেভিওয়েট লোকসভা প্রার্থী পার্থ ভূমিকার কাছে হার মানলেন অর্জুন।

অনেকেই বলেন এই আবারও বিজেপিতে ফিরে আসাটাই অর্জুনের জীবনের সব থেকে বড় ভুল। তৃণমূলের অন্দরের খবর, ব্যারাকপুরের বদলে অর্জুনকে নাকি দমদম লোকসভা অফার করা হয়েছিল। কারণ প্রবীণ সৌগত রায়কে নিয়ে নাকি কিছুটা নিমরাজি ছিলেন খোদ অভিষেকও। সোমনাথ, পার্থ, সুবোধের বিরোধিতাতে ব্যারাকপুরের টিকিট না পাওয়ার ক্ষতি পুষে দেওয়ার আরও একটা অফার দেওয়া হয়েছিল। পার্থ ভৌমিকের ছেড়ে যাওয়া নৈহাটিতে উপনির্বাচনে টিকিটের আশ্বাস। কিন্তু অর্জুন কোনোটাতেই রাজি হননি।

আর এবার উপ নির্বাচনেও বিজেপির থেকে টিকিট পেলেন না অর্জুন। এখন প্রশ্ন উঠছে, হারের পর কোনঠাসা অর্জুনকে কি কার্যত বাতিলের তালিকাতেই ফেলে দিল বিজেপি? একটা সময় অবধি ব্যারাকপুরে নির্বাচন অর্জুন সিংকে ছাড়া ভাবাই যেত না। সেখানে অর্জুন বা অর্জুনের পরিবারের কেউ প্রার্থী হচ্ছেন না সেটাই অবাক লাগছে অনেকের কাছে। সম্প্রতি খোদ অর্জুনের বাড়ির দোরগোড়ায় বোমাবাজির ঘটনা ঘটেছে। যা দেখে অনেকেই মনে করছেন যে ক্রমশ পায়ের তলায় মাটি হারাচ্ছেন অর্জুন।

সব মিলিয়ে অর্জুনের বর্তমান অবস্থা দেখে সেই বিখ্যাত গানের লাইনটা মনে পড়ে যাচ্ছে – “আজ যে রাজা, কাল সে ফকির, মজার দুনিয়ায়, মন্দ ভালো, সাদা কালো, জীবন বয়ে যায়”। জীবন আর ব্যারাকপুরের পাশের গঙ্গা, বয়ে তো চলেইছে। তবে অর্জুনের রাজনৈতিক জীবনের প্রবাহ কোন দিকে যাবে সেটা হয়তো আগামী দিনে আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে।