জয় বন্দ্যোপাধ্যায়: কথায় আছে বাবারা নাকি কষ্ট পায় না৷ জীবন যুদ্ধে তাঁরা লৌহপুরুষ৷ সন্তানের কাছে বাবা একজন আদর্শ মানুষের পাশাপাশি একজন ভালো বন্ধু৷ মাথার ছাদ, শিশু জীবনের একটা প্রকাণ্ড গাছ৷ অনেক আগলে রাখে তার চারিপাশকে৷ কিন্তু মাথার ছাদটাই হারিয়ে গেলে এই বিশ্বে একা মনে হয়৷ এক মুহুর্তের জন্য মনে হয় এবার আর হাত ধরার কেউ থাকবে না৷
শুক্রবার। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর একটা। চিকিৎসকদের একটি শব্দ যেন আমার কাছে বাজ পড়ার মতো ঘটে গেল। যখন আমার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। জীবনে অনেক যুদ্ধ করেছেন। আমাকে বাঁচাতে, সাহস জোগাতে, অন্ধকার জীবন থেকে আলোর পথে ঠেলে দিয়েছিলেন আমার বাবা। আজ যা কিছু আমি আমার বাবা, সত্যরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্যই।
তাঁর জীবনে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ৫ বছর থেকেই৷ বার্মার সুন্দর শহর মেমিওতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সত্যরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়৷ দাদু ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়র। বার্মা বনাম জাপানের যুদ্ধে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। যখন বার্মায় অতর্কিত হামলা চলছে৷ একের পর এক হেলিকপ্টার থেকে মুহুর্মুহু বোমা বর্ষণ চলছে৷ ঝাঁকে ঝাঁকে প্লেন আসতে শুরু করেছে। ঠাকুমাকে গিয়ে বললেন শত্রু বিমান আক্রমণ করেছে৷ ঠাকুমা বলল সাইরেন তো বাজেনি৷ তবুও সকলকে নিয়ে ট্রেঞ্চে চলে যেতে বললেন তিনি। দুই ভাইকে নিয়ে ট্রেঞ্চে চলে গেল বাবা। সেবার না গেলে অনেক লোকের জীবনহানি হত৷ তখন থেকেই জীবন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা৷
আমার দাদুর বাড়ি ছিল বরিশালে। সেখান থেকে ঘুরতে ঘুরতে গুয়াহাটি হয়ে পাঞ্চেতে ওঠেন। কারণ, পাঞ্চেত বাঁধ নির্মাণের কাজে নিযুক্ত ছিলেন তিনি৷ তাই বাবাদেরকেও সঙ্গে যেতে হয়েছে। সেখান থেকে হাজারিবাগের সেন্ট কলাম্বাস কলেজে পড়তেন৷ আমার মা ও সেখানে পড়াশুনা করতেন৷ সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে৷ রিক্সা করে আসার সময় পর্দা ফেলে আসতেন৷ সিনেমার কায়দায় মাকে প্রেমে ফেলে বিয়ে করেন বাবা।
শুরুতে ওষুধের কোম্পানি ফ্র্যানকরোসে ৫৬ টাকার মাসিক বেতনে কাজ করতেন। এরপর মালগাড়ির গার্ড হিসাবে কাজ করেছেন৷ তখনই খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে ইন্টারভিউ দেওয়া শুরু করেন৷ তখনই পুলিশ সার্জেনের ইন্টারভিউ দিতে যান৷ সেখানে লেখা ছিল উচ্চতা ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি এবং বুকের ছাতি হতে হবে ৩৮৷ কিন্তু বাবার বুক ছিল ৩৬ ইঞ্চি। শিয়ালদহে একটি বাড়িতে থাকাকালীন নিয়মিত দু’ঘন্টা করা শরীরচর্চা করতেন। কিন্তু তখনও বুকের মাপ ৩৭ ইঞ্চি ছিল৷ ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে দেখেন জাঁদরেল পুলিশ কমিশনাররা ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। নির্বাচিত না হয়েও মন জয় করেছিলেন। তাই অতিরিক্ত এক মাসের সময় দিতেই নিজেকে প্রমাণ করে দিলেন বাবা। পেলেন পুলিশের চাকরী৷
বাবার জীবন যুদ্ধের এই গল্প আমাকে বারবার উদ্বুদ্ধ করে। আজ আমি জয় ব্যানার্জী, সেখানে দাঁড়িয়ে আছি সুস্থ আছি, সেটা একমাত্র আমার বাবার জন্য। আগে আমি বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে মদ্যপান করতাম। আমার বাবা সেই ঠেকে গিয়ে, তা ভেঙে দিয়ে আমাকে তুলে এনেছিল। আজ আমাকে মদ ছাড়িয়ে, সিগারেট ছাড়িয়ে মানুষ করেছে, আমার বাবা।
আমি আমার বাবার ঋণ চোকাবার চেষ্টা করেছিলাম। ২০১৭ সালে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। কিডনি নষ্ট হতে শুরু করেছিল। ক্রিয়েটিনিন ইউরিয়া বাড়তে শুরু করে। ডাক্তারদের সঙ্গে তখন থেকে পরামর্শ নিয়ে যত্ন করতে শুরু করেছিলাম। কারণ, ডায়ালেসিস হলে কি হতো তা বলা যায় না। ধীরে ধীরে রোগ বাড়তে শুরু করল৷ অনেকে বলেছিল আর হয়তো একমাস, আবার কেউ বলেছিল দুমাস। কিন্তু বাবা নিজের ক্ষমতায়,আদর্শে নিজের মনের শক্তিতে এগিয়ে চলেছিল৷ যাতে জয় কে না একা হতে হয়। সেই চেষ্টাই প্রাণপন চালিয়েছিলেন তিনি।
২৪ এপ্রিল সাংঘাতিক অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ দ্রুত মেডিকা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ চিকিৎসকরা বলেছিলেন কিডনি ফেলিওর হয়েছে, হার্টের সমস্যা আছে এবং একই সঙ্গে ফুসফুসের কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেখানে প্রফেসর সুকুমার মুখোপাধ্যায়, ডা: কুণাল সরকার, ডা:তন্ময় ব্যানীর্জি, ডা: নন্দনী বিশ্বাস, প্রতিম সেনগুপ্ত, তপন সেনগুপ্ত এবং তমোজিৎ চক্রবর্তীর মতো বড়মাপের চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে চলছিল চিকিৎসা৷ বলা হয়েছিল আর একটা দিন কাটবে না। কিন্তু সেই যুদ্ধ জয় করে বাবা বাড়ি ফিরে আসেন।
১ মে থেকে চিকিৎসার জন্য বাড়িতেই সমস্ত বন্দোবস্ত করা হিয়েছিল৷ আলাদা করে দু’জন ব্রাদার্স রাখা হয়েছিল৷ সর্বদা ক্যাথিড্রাল এবং রাইস টউব পড়ানো ছিল৷ চিকিৎসকরা বলেছিলেন ৫০০ এর বেশী ইউরিন হলে পিজিটিভ দিক৷ কিন্তু ৫ থেকে ৬ তারিখ ইউরিন ছিল ৫৪৫৷ আমি যখন রিপোর্ট পাঠাই তখন চিকিৎসকরা বলেছিলেন তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছেন। এরপর ৫ তারিখ সন্ধ্যেবেলা ডক্টর প্রতিম সেনগুপ্ত তিনি চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাবার শারীরিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন৷ ডায়ালোসিসের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন৷ আমরা পজিটিভ সাইন পেয়ে সকলে আশ্বস্ত হলাম। সকলে মিলে দায়িত্ব ভাগ করে বাবার দেখভাল শুরু করলাম৷ আমি নিজে বাবার ইউরিন ঘন্টায় ঘন্টায় চেক পড়তাম সেটা দেখে ব্রাদাররাও বলছিল সুস্থ হচ্ছেন।
শুক্রবার আমি মায়ের সঙ্গে দুপুরে বসে কথা বলছি। এমন সময় আমার ভাই ছটু এসে বলে বাবার চিকিৎসার জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগবে৷ আমি গিয়ে দেখলাম শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা দ্রুত কমছে এবং পালস রেট বেড়েই চলেছে৷ সেই সময় কালক্রমে চিকিৎসক শুভজিৎ চক্রবর্তী আমার বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁকে ডাকতেই তিনি দ্রুত আমার বাড়ি আসেন৷ বাবাকে দেখে আমায় বলেন, জয় দা মন শক্ত করুন৷ দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স ডেকে স্পেশাল মনিটরে দেখা গেল কোনও শব্দ নেই৷ বাবাকে সেই মুহুর্তে হারালাম। আমি সুব্রত বক্সিকে ফোন করে জানালাম। তিনি বড় মনের মানুষ আমার দু্ঃখ বুঝে ডঃ ওঝার সঙ্গে কথা বলে ক্যাওড়াতলা শ্মশানে বাবার রাজকীয় শেষযাত্রার আয়োজন করা হল৷ সেদিন আমার প্রথম স্ত্রী অন্যন্যা, দ্বিতীয় স্ত্রী অঙ্কিতা বাড়িতেই ছিল৷ আর দিক প্রান্ত থেকে যারা খবর পেয়েছিল, তাঁরাই ছুটে এসেছিল৷ ১১৯ নম্বর ওয়ার্ডের নতুন কাউন্সিলর কাকলি বাগও আমাকে সাহায্য করছেন, বাবার ডেথ সার্টিফিকেট পেতে এবং শববাহী গাড়ি জোগার করে দিতে৷
সত্যরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় শুধুমাত্র মানুষ ছিলেন না। ছিলেনে একটা ব্র্যান্ড৷ পূর্ব ভারতে যতগুলি সিকিউরিটি এজেন্সি রমরমিয়ে ব্যবসা করছে এটা বাবার মস্তিষ্কপ্রসূত৷ তিনি নিজে অ্যানাপোল তৈরি করেছিলেন৷ বাবা অ্যানাপোলের ফাউন্ডার, ডিরেক্টর ছিলেন৷ পুলিস অফিসার্স গিল্ডের সভাপতি ছিলেন৷ চাকরী জীবনের পর বহু তাবড় পুলিশ অফিসার অ্যানাপোলে যোগদান করেন। সুনিপুন গোয়েন্দা ছিলেন। বিবিসি সহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তাঁর সাক্ষাতকার নেওয়া হয়েছিল৷
সত্যরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় আসলে একটা অসীম সাগর৷ তিনি একজন ভালো অভিনেতা হতে পারতেন৷ অনেকে তাঁকে প্রদীপ কুমারের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতেন। তাঁর বিচক্ষণতা আমার থেকেও একজন ভালো রাজনীতিবীদ করতে তুলতে পারত৷ কিন্তু তিনি তা করেননি৷ সর্বদা মানুষের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন৷ তাই আমি যখন রাজনীতিতে এসেছিলাম আমাকে বলেছিলেন একটি পয়সাও না নিই৷ আমি তা করিনি। আজ আমি, আমার বোন সবটাই করতে পেরেছি বাবার জন্য। চুড়ান্ত কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে বৌ এবং মা এর গয়না বন্ধক দিয়ে বাবাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তা পারিনি। আমি বাবার মৃত্যুর পর এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেনি। নিজেকে শক্ত করে রেখেছি৷ জানিনা কতদিন পারব নিজেকে এভাবে শক্ত করে ধরে রাখতে৷ আমার ভালো-খারাপও সবকিছুতে বাবা জড়িয়ে৷ এধরনের আদর্শবান মানুষ সকলের ঘরে ঘরে আসুক আমি এটাই কামনা করি৷