বাংলার নববর্ষের প্রথম দিনেই রাজ্যজুড়ে আলোড়ন ফেলে দিল জাল পাসপোর্ট কেলেঙ্কারি। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই দুর্নীতির পর্দাফাঁস করতে কোমর বেঁধে নেমেছে কেন্দ্রীয় সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) (ED)। মঙ্গলবার সকাল থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয়েছে একযোগে তল্লাশি (ED) অভিযান। কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া-সহ মোট আটটি জায়গায় হানা দিয়েছে ইডি আধিকারিকরা।
তদন্তে উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য
সূত্রের খবর অনুযায়ী, কলকাতার বেকবাগান থেকে শুরু করে উত্তর ২৪ পরগনার বিরাটি এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চল নদিয়ার গেদে— এসব এলাকায় সক্রিয় ছিল একাধিক পাসপোর্ট এজেন্ট (ED) । এজেন্টদের মাধ্যমেই জাল বা ভুয়ো পরিচয়পত্র দিয়ে তৈরি করা হচ্ছিল ভারতীয় পাসপোর্ট। তদন্তে উঠে এসেছে এমন বহু নাম, যাদের পরিচয় কাগজে-কলমে ভারতীয় হলেও, বাস্তবে তারা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী।
লালবাজারের গোয়েন্দা দপ্তর মাসখানেক আগেই এই চক্রের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিয়েছে। ১৩০ পাতার সেই চার্জশিটে বলা হয়েছে, গ্রেফতার হওয়া ১৩০ জনের মধ্যে ১২০ জনই বাংলাদেশি নাগরিক। বাকি ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম নাম প্রাক্তন পুলিশ অফিসার আবদুল হাই, যিনি নথি জালিয়াতির কাজে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ।
বড়সড় চক্রের সন্ধান
ইডি (ED) তদন্তে জানতে পেরেছে, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে বড় অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তৈরি করা হচ্ছিল এসব পাসপোর্ট। স্থানীয় কিছু অসাধু এজেন্ট সীমান্ত পেরিয়ে আসা বাংলাদেশিদের কাছে টাকার বিনিময়ে ‘ভারতীয় পরিচয়’ গড়ে দিচ্ছিলেন। ভুয়ো জন্ম সনদ, আধার কার্ড, রেশন কার্ড বানিয়ে এগুলোর ভিত্তিতে তৈরি হচ্ছিল ভারতীয় পাসপোর্ট। এদের সাহায্যে অনুপ্রবেশকারীরা শুধু ভারতে থাকার অধিকারই পেয়ে যাচ্ছিলেন না, বরং অনায়াসে বিদেশেও পাড়ি দিচ্ছিলেন।
বিরাটিতে তল্লাশি, বিদেশ ফেরত ব্যক্তি ইডি-র নজরে
ইডি (ED) সূত্রে জানা গিয়েছে, বিরাটিতে যে বাড়িতে মঙ্গলবার সকালে তল্লাশি চালানো হয়েছে, সেই ব্যক্তি সম্প্রতি বিদেশ থেকে ফিরেছেন। তাঁর পাসপোর্টের ভিত্তি যাচাই করতে গিয়ে নানান অসঙ্গতি সামনে আসে। তদন্তকারীরা এখন তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানার চেষ্টা করছেন, কীভাবে তিনি এই পাসপোর্ট তৈরি করলেন, এবং কারা তাঁকে সাহায্য করেছে। প্রয়োজনে তাঁকে গ্রেপ্তার করেও তদন্তে নেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছে ইডি।
এজেন্টদের খোঁজে তল্লাশি তীব্রতর
তদন্তে উঠে আসা এজেন্টদের তালিকা অনুযায়ী, ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজনকে নজরদারির আওতায় এনেছে ইডি (ED) । জানা যাচ্ছে, এই চক্রের নেটওয়ার্ক শুধু সীমান্তবর্তী এলাকায় সীমাবদ্ধ নয়, কলকাতাতেও রয়েছে তাদের একাধিক সক্রিয় ঘাঁটি। পাসপোর্ট অফিস, স্থানীয় প্রশাসন এবং রাজনৈতিক সংযোগও খতিয়ে দেখছে ইডি।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইঙ্গিতপূর্ণ অভিযান
বাংলায় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। এই সময়ে জাল পাসপোর্ট ইস্যুতে ইডি-র সক্রিয়তা রাজনৈতিক মহলেও ব্যাপক আলোড়ন ফেলেছে। কেন্দ্রীয় সংস্থার এই তল্লাশি কাকতালীয় নাকি পরিকল্পিত, তা নিয়ে শুরু হয়েছে চর্চা। তবে ইডি স্পষ্ট জানিয়েছে, তাদের তদন্ত সম্পূর্ণ তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে এবং আইনি প্রক্রিয়া মেনেই করা হচ্ছে।
বাংলার পাসপোর্ট দুর্নীতির চক্র যে কতটা গভীর, তারই একটা ঝলক মিলছে ইডি-র এই পদক্ষেপে। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের মাধ্যমে দেশের নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব এবং পরিচয়ের যে প্রশ্ন উঠে এসেছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই চক্রের গোড়া পর্যন্ত পৌঁছে দায়ীদের শাস্তি দেওয়ার পথে কতদূর এগোতে পারে ইডি, সেটাই এখন দেখার।