বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালির অগ্রণী ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। বিপ্লবী মতিলাল, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, মাস্টারদা সূর্য সেন থেকে শুরু করে countless known and unknown freedom fighters তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন এই দেশের স্বাধীনতার জন্য। সেই বাঙালি জাতির আত্মত্যাগ, আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি ও অস্মিতা যেন হারিয়ে না যায় আধুনিকতার মোড়কে—এমনই আশঙ্কা থেকেই বারবার সতর্ক করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সম্প্রতি এক প্রশাসনিক সভা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়াদের উদ্দেশে বিশেষ বার্তা দেন। তিনি বলেন, “যাঁরা ইংলিশ মিডিয়ামেও পড়েন, তাঁরা নিজের অস্তিত্বটাকে মনে রাখবেন, নিজের ঠিকানাটা মনে রাখবেন।” এই বক্তব্য শুধুমাত্র একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নয়, এক বৃহত্তর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে মূল্যবান ইঙ্গিত বহন করে।
আধুনিক ভারতের সমাজব্যবস্থায় ইংরেজি ভাষা ও সংস্কৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু সেই সূত্রেই ক্রমে মুছে যেতে বসেছে আমাদের মাতৃভাষা, সংস্কৃতি এবং শিকড়ের সঙ্গে যোগাযোগ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য সেই ভুলে যাওয়া শিকড়কে মনে করিয়ে দেওয়ার একটি প্রয়াস। তাঁর কণ্ঠে ছিল না কোনও বিরোধিতা বা প্রতিক্রিয়া, বরং ছিল এক মমতাময়ী মাতৃকণ্ঠের স্নেহপূর্ণ আহ্বান—“সব ভুলে যেতে পারেন, কিন্তু নিজের অস্মিতাকে ভুলবেন না, নিজের ঠিকানাটা ভুলবেন না।”
এই ‘ঠিকানা’ শুধুমাত্র একটি বাড়ির ঠিকানা নয়, বরং আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, পারিবারিক মূল্যবোধ এবং জন্মভূমির প্রতি দায়বদ্ধতার প্রতীক। যাঁরা বিদেশে পড়তে যাচ্ছেন কিংবা কর্পোরেট জীবনে ইংরেজির আধিপত্যে বড় হচ্ছেন, তাঁদের কাছে এ এক মূল্যবান বার্তা। নিজের কুটিরঘর, মা-বাবা, শিক্ষক-শিক্ষিকারা—যাঁদের হাত ধরে প্রথম অক্ষর চেনা—তাঁদের ভুলে গেলে সেই শিক্ষার আসল মূল্য থেকেই দূরে সরে যাওয়া হয়।
আজকের সমাজে অনেক অভিভাবকই সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ান ‘ভবিষ্যতের কথা ভেবে’। কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে যদি নিজস্ব শিকড়ের সংযোগ না থাকে, তাহলে তা একদিক থেকে আত্মবিচ্ছিন্নতা ডেকে আনে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ কথাই বারেবারে বোঝাতে চেয়েছেন—শুধু আধুনিক হওয়া নয়, নিজের শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত থাকা আরও বেশি জরুরি।
বাঙালি জাতির অহংকার তার ভাষা, সংস্কৃতি এবং সংগ্রামী চেতনা। সেই জাতিসত্তাকে বিস্মৃত হয়ে শুধু বিদেশি সংস্কৃতির মোহে ডুবে যাওয়া এক ধরণের আত্মবিরোধিতা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বার্তা তাই নিছক রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, এটি এক সামাজিক জাগরণের ডাক, যা আজকের তরুণ প্রজন্মকে তাঁর শিকড়ে ফেরার অনুপ্রেরণা জোগায়।
বাংলার মাটি, তার সংস্কৃতি, তার কুটিরঘর, মা, বাবার স্নেহ, শিক্ষকের আদর্শ—এই সব কিছু মিলেই তৈরি হয় এক জন ব্যক্তি, এক জন বাঙালি। ইংরেজি শিখুন, বিশ্বকে জানুন—তাতে কোনও বাধা নেই। কিন্তু নিজের ঘর, নিজের ঠিকানা, নিজের পরিচয়কে মনে রাখতে হবে—এই আহ্বানই মুখ্যমন্ত্রীর কণ্ঠে উঠে এসেছে গভীর আবেগে।
আজকের দিনে এই বার্তা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে আমরা যদি আমাদের শিকড় হারিয়ে ফেলি, তাহলে আমাদের গ্লোবাল পরিচয়ও একসময় ফিকে হয়ে যাবে। তাই নিজের অস্তিত্বকে ধারণ করে, নিজের সংস্কৃতিকে সম্মান জানিয়ে এগিয়ে চলাই হবে প্রকৃত আধুনিকতা।