কলকাতায় ডিজিটাল অ্যারেস্টের জাল, ৫৭ লক্ষ টাকা খোয়ালেন মহিলা

বিগত কয়েক মাসে ডিজিটাল প্রতারণার ঘটনা বেড়ে চলেছে, বিশেষ করে “ডিজিটাল অ্যারেস্ট” (Digital arrest) বা অনলাইনে গ্রেপ্তারি দেখিয়ে টাকা আদায়ের মতো ভয়ংকর কৌশল। পুলিশ এবং…

Cyber crime

বিগত কয়েক মাসে ডিজিটাল প্রতারণার ঘটনা বেড়ে চলেছে, বিশেষ করে “ডিজিটাল অ্যারেস্ট” (Digital arrest) বা অনলাইনে গ্রেপ্তারি দেখিয়ে টাকা আদায়ের মতো ভয়ংকর কৌশল। পুলিশ এবং সাইবার বিশেষজ্ঞরা বারবার এই ধরনের প্রতারণার (scam) বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করলেও প্রতারকরা তাদের ফাঁদে সহজেই মানুষদের ফাঁসাচ্ছে। এরই মধ্যে কলকাতায় (Kolkata) এক মহিলা (woman) ৫৭ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা হারিয়েছেন একই ধরনের প্রতারণার শিকার হয়ে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সিবিআই অফিসার পরিচয়ে এক বা একাধিক প্রতারক অনিতা বাগচির কাছ থেকে তিন দফায় এই বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

ঘটনার বিবরণ:
কলকাতার রুবি মোড়ের একটি আবাসনে বসবাসকারী অনিতা বাগচি (৬৫) একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীর স্ত্রী। তার স্বামী ছিলেন ওএনজিসি–র উচ্চপদস্থ অফিসার। ২০২১ সালে কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হয়ে স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে তিনি নিজের জমানো টাকা দিয়ে সংসার চালাচ্ছিলেন। একমাত্র ছেলে খড়্গপুর আইআইটি-র প্রাক্তনী, বর্তমানে লন্ডনে কর্মরত। ছেলের অভাব নেই, তবে মা একা থাকায় একমাত্র সন্তানের প্রতি খুবই একনিষ্ঠ।

   

ছটপুজোর দিন সকালে, এক মহিলা ভিডিও কল করে অনিতাকে জানায় যে, তার নাম সুরেশ কুটে এবং সে দিল্লির একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে কাজ করে। ওই ব্যক্তি দাবি করেন, অনিতার জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে লক্ষ লক্ষ টাকার অবৈধ লেনদেন হয়েছে। তার পরিণতি হিসেবে, অনিতাকে ডিজিটাল অ্যারেস্ট করা হয়েছে এবং তাকে অন্তত ১৪ দিন জেলে থাকতে হবে। এমনকি তার ছেলের চাকরিও চলে যাবে বলে ভয় দেখানো হয়।

এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে অনিতা প্রচণ্ডভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। পরবর্তী সময়ে, ওই মহিলারা তাকে গ্রেপ্তারি রোধ করার জন্য কিছু টাকা খরচ করতে হবে বলে জানায়। এরপর তারা তাকে একটি ফর্ম পাঠায়, যাতে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর দেওয়া ছিল। অনিতার মাথায় ঘুরতে থাকে, “আপনি যদি টাকা না দেন, তবে গ্রেপ্তারি আটকানো সম্ভব হবে না। আপনার ছেলের চাকরি চলে যাবে, সব শেষ হয়ে যাবে।” এই ভয়াবহ হুমকি তার মনকে এতটাই দুর্বল করে তোলে যে, তিনি প্রতারকদের কথা মতো ১১ নভেম্বর প্রথম আরটিজিএসে ৩০ লক্ষ টাকা পাঠিয়ে দেন।

টাকা চাওয়া চলতে থাকে:
এর পর, কয়েক দিন পরে আবার ফোন করে অনিতাকে বলা হয় যে, তদন্তের জন্য আরও টাকা দরকার। তাদের কথায় বিশ্বাস রেখে তিনি ১৬ নভেম্বর সিনিয়র সিটিজেন স্কিম ভেঙে ১৫ লক্ষ টাকা পাঠান। এক সময়, সুমেধা নামে অন্য একজন আইপিএস অফিসার পরিচয়ে ফোন করে আরও টাকা দাবি করে। সুমেধার কথা শুনে, ১৯ নভেম্বর, অনিতা আরও ১২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা পাঠান। ফলে, একাধিক দফায় তিনি মোট ৫৭ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা প্রতারকদের হাতে তুলে দেন।
পুরো পরিস্থিতি এতটাই আতঙ্কজনক হয়ে উঠেছিল যে, অনিতা কোনও আত্মীয় বা বন্ধুর কাছে কিছু জানাননি। এমনকি, ছেলেকেও কোনো কিছু বলেননি। একে একে তার সমস্ত জমানো টাকা চলে যাওয়ার পর, অবশেষে তিনি থানায় অভিযোগ করতে যান।

পুলিশের তদন্ত ও সচেতনতায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ:
পুলিশ জানায়, এ ধরনের প্রতারণা এখনই থামানো যাবে না, যদি সাধারণ মানুষ সচেতন না হয়। প্রতারণার এই নতুন কৌশলটি ধরা পড়লেও, বহু মানুষ এমন ঘটনা সম্পর্কে অবগত নয় এবং তাই তারা সহজেই প্রতারকদের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে। পুলিশ কর্তৃপক্ষ জানায়, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে এবং প্রতারকদের চিহ্নিত করার জন্য সমস্ত সাইবার (Cyber) প্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে।
সাইবার বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করেছেন যে, কোনো পরিস্থিতিতেই ফোন কল, ইমেল বা মেসেজের মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য বা টাকা পাঠানো উচিত নয়। আর যদি কখনও এমন ধরনের ফোন আসে, তবে তা অবিলম্বে পুলিশকে জানানো উচিত।

এছাড়া, সাইবার নিরাপত্তার জন্য কিছু সাধারণ নিয়ম অনুসরণ করা জরুরি। যেমন, কোনো অপরিচিত নম্বর থেকে আসা ফোন বা মেসেজে বিশ্বাস না করা, ব্যক্তিগত তথ্য বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিবরণ কখনোই শেয়ার না করা এবং ব্যাংক বা সরকারি অফিসের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনও তথ্য পাওয়ার জন্য সরাসরি তাদের অফিসে যোগাযোগ করা।

এদিকে, পুলিশ প্রতারকদের ধরার জন্য বিভিন্ন ধরনের সাইবার ট্র্যাকিং পদ্ধতি ব্যবহার করছে এবং আশা করা হচ্ছে শীঘ্রই তারা অপরাধীদের আটক করতে সক্ষম হবে।

সাধারণ মানুষকে সাবধান থাকতে হবে:
এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। শুধু কলকাতা নয়, দেশের অন্যান্য শহরেও এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। পুলিশ ও সাইবার বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, “এ ধরনের অপরাধ রোধ করতে হলে সচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ যতদিন পর্যন্ত সাবধান হবে না, ততদিন পর্যন্ত এ ধরনের অপরাধ অব্যাহত থাকবে।”

এদিকে, অনিতার মতো বহু মানুষ আছেন, যারা প্রতারকদের ফাঁদে পড়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হারাচ্ছেন, অথচ তাদের অনেকেই এসব বিষয়ে সঠিকভাবে অবহিত নন। সুতরাং, সাইবার (Cyber) নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের পাশাপাশি সোসাইটি ও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোকেও এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর প্রয়াস চালাতে হবে।

ডিজিটাল যুগে, যখন প্রযুক্তি প্রতিদিনই নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করছে, তখন সেই সুযোগগুলোর অপব্যবহারও অবশ্যম্ভাবী। ডিজিটাল প্রতারণার এই ঘটনাগুলি মানুষের আস্থা এবং নিরাপত্তার ওপর আঘাত হানছে। তবে, সচেতনতা এবং সাবধানতা অবলম্বন করে এই ধরনের প্রতারণা থেকে বাঁচা সম্ভব। শুধু পুলিশ ও সাইবার (Cyber) বিশেষজ্ঞরা নয়, সাধারণ মানুষকেও এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।