বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে নতুন করে সাজানো হচ্ছে ভূ-রাজনৈতিক মোহরা। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হঠাৎই ছন্দপতনের (Trump-Modi Rift) দিকে, অন্যদিকে চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ হতে শুরু করেছে। এই নতুন প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক সমীকরণে বড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের উপর।
মোদী-ট্রাম্প সম্পর্কে ফাটল!
প্রায় এক দশক ধরে ট্রাম্প ও মোদী একে অপরের “ন্যাচারাল অ্যালাই” বলে পরিচিত ছিলেন। ‘Howdy Modi’ কিংবা ‘Namaste Trump’-এর মতো অনুষ্ঠান বিশ্ববাসী দেখেছে। কিন্তু সময় বদলেছে। ট্রাম্প সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন যে, তাঁর প্রশাসন ভারতীয় রপ্তানি পণ্যের উপর ২৫% শুল্ক আরোপ করবে। এর বিপরীতে পাকিস্তানকে দেওয়া হবে মাত্র ১৯% শুল্ক ছাড়, পাশাপাশি দেশটির সঙ্গে একটি বিপুল পরিমাণের তেল অনুসন্ধান চুক্তিও করা হবে।
এই সিদ্ধান্ত ভারতীয় বাণিজ্যিক স্বার্থে বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা দিয়েছে এবং ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি সুস্পষ্ট পরিবর্তনও প্রতিফলিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিদ্ধান্ত ভারতের উপর আমেরিকার চাপ তৈরির একটি কৌশল হতে পারে, তবে ভারতের প্রতিক্রিয়া বিষয়টিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।
মোদীর চীন সফর: নতুন সম্পর্কের ইঙ্গিত?
ট্রাম্প প্রশাসনের এই অবস্থানের মধ্যে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর চীন সফরের ঘোষণা আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ২০২০ সালের গালওয়ান সংঘর্ষের পর এই প্রথম মোদী চীন সফর করবেন। তিনি ৩১ আগস্ট শাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন, যেখানে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সফর শুধু একাধিক রাষ্ট্রনেতার মধ্যে কূটনৈতিক সৌজন্য বিনিময় নয়, বরং ভারত-চীন সম্পর্কে নতুন ধাপের সূচনা হতে পারে বলেই মনে করছেন কূটনৈতিক মহল। বিশেষত গালওয়ান পরবর্তী উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে এটি একটি ‘কঠিন কিন্তু প্রয়োজনীয়’ পদক্ষেপ।
উদ্বেগে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান
ভারত ও চীনের এই সম্ভাব্য ঘনিষ্ঠতা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জন্য নতুন চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্ক বরাবরই দৃঢ়। সম্প্রতি পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে সংঘর্ষের সময় চীনা তৈরি J-10 যুদ্ধবিমান ও PL-15 মিসাইল ব্যবহারের সাফল্য ইসলামাবাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ালেও, ভারত-চীন সম্পর্ক উন্নত হলে সেই নির্ভরতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বিষয়টি জটিল। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বেড়েছে। মার্চ ২০২৫-এ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে চীন সফরে গিয়ে বাংলাদেশ ২.১ বিলিয়ন ডলারের ঋণ, অনুদান ও বিনিয়োগ চুক্তি করে। এই সম্পর্ক যদি চীন ভারতকে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করে তাহলে হুমকির মুখে পড়তে পারে।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস রপ্তানিতে চীনের বিনিয়োগ বেড়েছে, তবে ভারত বরাবরই বাংলাদেশের স্থায়ী বাণিজ্যিক ও কৌশলগত সহযোগী। তাই চীনের সঙ্গে ভারতের নতুন বন্ধুত্বের সমীকরণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লাভ কমে যেতে পারে। বর্তমান বাংলাদেশের মধ্যবর্তী সরকার এখন কৌশলী অবস্থান নিচ্ছে — চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখে, ভারতকেও খুশি রাখার চেষ্টায় আছে।
সীমান্ত বিরোধ: ভারত-চীন সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ
তবে ভারত-চীন ঘনিষ্ঠতা এখনো মসৃণ নয়। সীমান্ত বিরোধ, বিশেষ করে অরুণাচল প্রদেশ ও গালওয়ান উপত্যকা নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী মতবিরোধ রয়ে গেছে। সামরিকভাবে ভারত এখন আরও প্রস্তুত, কিন্তু সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হলে বিশ্বাসযোগ্য উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন দুই পক্ষেরই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের ভারতের প্রতি কঠোর নীতিই মোদী সরকারকে নতুন কৌশল নিতে বাধ্য করেছে। ট্রাম্প প্রশাসন যদি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় ফিরে আসে, তবে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ভবিষ্যতও নতুন করে প্রশ্নের মুখে পড়বে।
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। মোদী-ট্রাম্প দূরত্ব যত বাড়ছে, ততই ভারত চীনের দিকে এগোচ্ছে। এই নতুন বন্ধুত্ব যেমন ভারতকে কৌশলগত সুবিধা এনে দিতে পারে, তেমনই বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জন্য উদ্বেগ বাড়াবে। তবে এখনও অনেক কিছুই নির্ভর করছে সামনের কূটনৈতিক আলোচনার উপর। আর এই পরিবর্তনের প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার শক্তির ভারসাম্যে বড়সড় পরিবর্তন অদূর ভবিষ্যতেই দেখা যেতে পারে।