কভি খুশি কভি গম

দিন কতক আগে তৃণমূল কংগ্রেসের সেনাপতির গলায় এ রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট না হওয়ায় প্রকাশ্যেই আক্ষেপ করছেন। ‘আমরা তো চেয়েছিলাম জোট হোক। সেজন্যই তো আমি…

Congress Dismisses TMC Leader Mamata Banerjee

দিন কতক আগে তৃণমূল কংগ্রেসের সেনাপতির গলায় এ রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট না হওয়ায় প্রকাশ্যেই আক্ষেপ করছেন। ‘আমরা তো চেয়েছিলাম জোট হোক। সেজন্যই তো আমি কাকভোরে রাহুল গান্ধির দরজায় কড়া নেড়েছিলাম। আমরা তারপরে অনেক দিন অপেক্ষা করেছি, কংগ্রেসের তরফে সঙ্কেত না আসায় আমরা একলা চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

আমরা চেয়েছিলাম মানেটা কী? মানে হোল তোমাদের জেতা দুটো আসন মালদহ দক্ষিণ আর বহরমপুর তোমাদের ছেড়ে দেব, বিনিময়ে মেঘালয় ও অসমে আমাদের একটা করে আসন দিতে হবে। এই হোল তৃণমূলের সমঝোতার শর্ত। কংগ্রেসের দিল্লির নেতারা অন্তত ছয়-সাতটি আসন চেয়েছিলেন, মমতা কর্ণপাত করেননি। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত তাঁর কথাই শিরোধার্য হবে, মোল্লার দৌড় যে মসজিদ পর্যন্ত সেকথা তিনি বিলক্ষণ জানেন।

   

মমতা মনে করেছিলেন তিনি যা বলবেন গান্ধি পরিবার সেটাই বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেবে। দোষ পুরোপুরি তাঁর নয়। কংগ্রেস ভেঙে মমতা নিজের দল গড়েছেন, ক্ষমতায় আসার পরে যে সব জেলায় কংগ্রেসের সংগঠন মজবুত ছিল সেখানে প্রলোভন আর পুলিশের ডান্ডা দিয়ে স্টিম রোলার চালিয়েছেন, অথচ পশ্চিমবঙ্গের প্রশ্ন যখনই এসেছে সনিয়া গান্ধি ওই মমতার হাতেই তামাক খেয়েছেন। সে ২০০১ অথবা ২০১১ এর বিধানসভা হোক বা ২০০৯ এর লোকসভা। বিনিময়ে মমতা কী করলেন? গোড়ায় কিছুদিন কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার চালানোর পরে কংগ্রেসকে অর্ধচন্দ্র দিলেন, দিল্লির নেতৃত্ব কোনও কথাই বললনা। তাহলে এবার কংগ্রেস হাইকমান্ডের প্রতিক্রিয়া অন্য রকম হোল কেন?

এবার কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে আর সনিয়া গান্ধি নেই, পুত্র-কন্যার হাতে দলের দায়িত্ব সঁপে দিয়ে তিনি দৈনন্দিন কাজকর্ম থেকে অবসর নিয়েছেন।পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর অঙ্কে এখানেই বড় ভুলটা হয়ে গিয়েছিল। মায়ের মতো তৃণমূল নেত্রী সম্পর্কে সনিয়া তনয়ের কোনও দুর্বলতা নেই। ‘হি সাফারস হার’ এই পর্যন্ত। মমতার বিজেপি বিরোধিতা কতটা খাঁটি তা নিয়েও রাহুলের মনে ঘোরতর সন্দেহ আছে। মেঘালয় বিধানসভার ভোটে প্রচারে গিয়ে এইতো সেদিন রাহুল তৃণমূলকে বিজেপির বি-টিম বলে প্রকাশ্য জনসভায় তোপ দেখেছিলেন। রাহুলের বক্তব্য ছিল, গোয়া, ত্রিপুরা এবং মেঘালয়ে টি এম সি-র ঝান্ডা ধরার লোক নেই, তবু তারা এই রাজ্যগুলিতে ভোট লড়তে গিয়েছে কেন? একটাই উদ্দেশ্য নিয়ে, কংগ্রেসের ভোট কেটে বিজেপির জয়ের রাস্তা মসৃণ করে দিতে।

তারপরে দীর্ঘদিন দুই দলের পারস্পরিক সম্পর্ক একেবারে তলানিতে এসে পৌঁছেছিল। বিজেপি বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলি কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে ‘ইন্ডিয়া’ জোট গড়ার উদ্যোগ নিলে আবার দুই দল কাছাকাছি আসে। জোটের পাটনা বৈঠকের শেষে সাংবাদিদের কাছে আহ্লাদিত মমতাকে প্রকাশ্যে বলতে শোনা যায়,’রাহুল ইজ আওয়ার লিডার।’ সেই মধুচন্দ্রিমাও ছিল ক্ষণিকের। জোটের মুম্বাই বৈঠকেই ফের দূরত্ব বাড়তে শুরু করে, মমতা ধীরে ধীরে নিজেকে ওই জোট থেকে সরিয়ে নেন। আবার তাঁর বিবিধ বক্তৃতায় কংগ্রেস বিরোধিতার ঝাঁঝ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রেড রোডের ধর্ণামঞ্চ থেকে মমতাকে বলতে শোনা যায়, ‘ আমি কংগ্রেসকে বলেছি, লড়তে হয় উত্তরপ্রদেশে গিয়ে লড়, বেনারসে গিয়ে লড়, বাংলায় আমরা যা বলব তাই শুনে তোমাদের চলতে হবে। আগে ৫০টি আসনে জিতে দেখাও তারপরে তোমাদের কথা শুনব।’

লোকসভা ভোটের চারটি পর্ব সমাধা হওয়ার পরে ফের ‘ইন্ডিয়া’ জোটের জন্য মন কেমন করতে শুরু করেছে মুখ্যমন্ত্রীর। এবারের ভোটে বিজেপি এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নাও পেতে পারে বুঝতে পেরে মমতা এখন নিজেকে এই জোটের জননী বলে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন। একবার বলছেন বিরোধী জোট সরকার গড়লে বাইরে থেকে তাকে সমর্থন করবেন, পরের দিনই আবার পাল্টি খেয়ে বলছেন,’ না, না, আমার কথা বুঝতে ভুল হয়েছে, আমরা অবশ্যই জোট সরকারে থাকব।’ এমনকী তিনি সরকারে গেলে কী কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, কারও সঙ্গে পরামর্শ না করে একতরফাভাবে তাও ঘোষণা করেছেন। বলেছেন,’ সি এ এ, এন আর সি বন্ধ করে দেব, ই ডি আর সি বি আই এই দুটোকেও তুলে দেব।’ এক্কেবারে মামা বাডির আবদার আর কী!

ইন্ডিয়া জোট সম্পর্কে মমতার বিরহ বেদনার গাথা রচনা করব পরে। তার আগে কংগ্রেসের পরিবর্তিত কার্যপদ্ধতির কথা ছুঁয়ে যাওয়া প্রয়োজন দুই কংগ্রেসের জোট হোলনা কেন তার পরিপ্রেক্ষিতটি পরিষ্কার করতে। দিল্লি যা বলবে রাজ্য নেতৃত্বকে সেই আদেশই বিনা বাক্যব্যয়ে শিরোধার্য করতে হবে কংগ্রেসে এতদিন সেটাই ছিল দস্তুর, অলিখিত আইন। এমন তালিবানি শৃঙ্খলার কারণে এ রাজ্যে কংগ্রেস দীর্ঘ বাম-জমানায় নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিরোধী দল হিসাবে কংগ্রেস মানুষের কাছে বিশ্বাসযাগ্যতা হারিয়েছে, তার সুযোগ নিয়ে মমতা একদা নিজের দল গড়েছিলেন। রাহুল গান্ধির নয়া জমানায় সে পাঠ চুকে গিয়েছে, এখন রাজ্য নেতাদের পরামর্শ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কংগ্রেস হাইকমান্ড কোনও সিদ্ধান্ত নেয়না, একতরফাভাবে কোনও সিদ্ধান্ত নীচুতলায় চাপিয়েও দেওয়া হয়না। এবারের ভোটে সেই নতুন রীতি মেনে দলের প্রার্থী বাছাইয়ের আগে প্রতিটি রাজ্যের কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে, খোলামেলা আলোচনার মধ্যে দিয়ে সর্বসম্মতভাব গৃহীত হয়েছে সিদ্ধান্ত।

পশ্চিমবঙ্গের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় একজন ব্যতিরেকে উপস্থিত সবাই সমস্বরে তৃণমূলের সঙ্গে জোট করার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, কংগ্রসকে যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয়, তাহলে তৃণমূলের সঙ্গে জোট করার কথা বিবেচনাও করা সমীচীন নয়। এরপরে রাহুল অথবা মল্লিকার্জুন খাড়গে আর মমতার নামই উচ্চারণ করেননি। বরং কংগ্রেসকে ফের চাঙ্গা করার প্রত্যয়ের কথা শুনে রাহুল রাজ্য নেতাদের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছেন, তথাস্তু।  (শেষ)