আবারও বিস্ফোরক মন্তব্য করলেন নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন। রবিবার সকালে নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে তিনি দীর্ঘ একটি পোস্টে বাঙালি মুসলমানদের ইতিহাস, মানসিকতা এবং ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তীব্র আক্রমণ শানালেন। তাঁর মতে, ধর্মের মোড়কে এরা লালিত হয়েছে মূলত লোভের দ্বারা— স্বর্গীয় আরামের স্বপ্ন, অবাধ যৌনতার প্রলোভন, কিংবা ধর্মের নামে ক্ষমতা ভোগ করার মানসিকতা। সেই সঙ্গেই তিনি দাবি করেন, শিক্ষিত হলেও অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান এখনও উন্নত জীবনদর্শনে পৌঁছতে পারেনি। আর এই বক্তব্য ঘিরেই উঠেছে বিতর্ক।
তসলিমার বক্তব্য
তসলিমা নাসরিন লেখেন— “বাঙালি মুসলমানের পূর্বপুরুষ মূলত নিম্নবর্ণ হিন্দু। এদের শিক্ষাদীক্ষা ছিল না। ভগবানের গুণকীর্তণ ছাড়া এদের আলাদা কোনো সংস্কৃতি ছিল না। অধিকাংশই ছিল গরিব চাষি। পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর ধর্মটাই হয়ে ওঠে এদের একমাত্র সম্পদ। আজ অবধি ধর্মই এদের ধ্যান-জ্ঞান।”
তিনি আরও যোগ করেন, “ধর্ম এদের নানাভাবে লোভ দেখিয়েছে— পরকালে সুখ-সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি, অবাধ যৌনতার স্বপ্ন, ধর্মের নামে নির্যাতন ও হত্যা করার অধিকার, এবং সর্বোপরি এই বিশ্বাস যে ইসলামই সেরা ধর্ম। এইসবই এদের মনে এক ধরনের আত্মতুষ্টি এনে দিয়েছে। আধুনিক যুগে অনেকেই শিক্ষিত হয়েছে, চাকরি বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ এখনও নিম্নমানের জীবনদর্শনেই আটকে আছে। উন্নত মানুষ হতে গেলে এদের আরও কয়েক শতাব্দী অপেক্ষা করতে হবে।”
সীতাকুণ্ড প্রসঙ্গ টেনে মন্তব্য
তসলিমা জানান, এই মন্তব্যের পেছনে প্রেক্ষাপট হলো চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পাহাড়ের ঘটনা। সেখানে স্থানীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের উদ্যোগে একটি মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত হিন্দু মন্দিরের একেবারে পাশে। এই খবর শুনেই তসলিমা তাঁর ক্ষোভ উগরে দেন। তাঁর ভাষায়, “অন্য ধর্মের উপাসনালয়ের পাশে গিয়ে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করার চেষ্টা মুসলমানদের মধ্যে বহু পুরনো। এর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে এক ধরনের ধর্মীয় রাজনীতি ও ভোগবৃত্তি।”
প্রতিক্রিয়া
তসলিমার বক্তব্য ঘিরে ইতিমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। অনেকেই তাঁকে ‘ইসলামবিদ্বেষী’ আখ্যা দিচ্ছেন, আবার কেউ কেউ মনে করছেন তিনি যথার্থই ধর্মীয় ভণ্ডামি তুলে ধরেছেন।
বাংলাদেশে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের একাংশের মতে, তসলিমা যে বিষয়টি বলেছেন সেটি নিছক উস্কানি নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাঁদের যুক্তি, প্রাচীনকালে অর্থনৈতিক বা সামাজিক কারণে বহু নিম্নবর্ণ হিন্দু ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ফলে তাদের মানসিকতায় এক ধরনের ‘ধর্মকেন্দ্রিক নিরাপত্তা’ গড়ে ওঠে। তবে তসলিমার বক্তব্যের ভাষা আক্রমণাত্মক হওয়ায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে, ধর্মীয় নেতাদের একাংশ তসলিমার বক্তব্যকে ‘নিন্দনীয়’ বলে দাবি করেছেন। তাঁদের মতে, ইসলাম কোনোভাবেই লোভ দেখিয়ে ধর্মান্তর ঘটায়নি, বরং ন্যায়, সাম্য ও মানবতার বার্তা দিয়েছিল। তাঁদের অভিযোগ, তসলিমা নাসরিন বারবার ইসলামকে লক্ষ্য করে কটাক্ষ করে সমাজে বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছেন।
বিতর্কিত মন্তব্যে পুরনো ইতিহাস
এ প্রথম নয়, এর আগেও বহুবার তসলিমা নাসরিন ইসলাম ও মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে তির্যক মন্তব্য করেছেন। তাঁর লেখা বই লজ্জা প্রকাশের পরই বাংলাদেশে তীব্র বিতর্ক ও অশান্তি দেখা দিয়েছিল। এরপর থেকেই তাঁকে নির্বাসিত জীবনযাপন করতে হচ্ছে। কিন্তু তবুও তিনি সামাজিক মাধ্যমে নিয়মিতভাবে নিজের মতামত প্রকাশ করে চলেছেন।
সমালোচনা ও সমর্থন
বিশ্লেষকদের মতে, তসলিমার বক্তব্যে একটি তীক্ষ্ণ সামাজিক পর্যবেক্ষণ থাকলেও তাঁর ভাষা উস্কানিমূলক। ফলে সাধারণ মুসলমানদের মনে ক্ষোভ জন্মায় এবং ধর্মীয় বিভাজন আরও তীব্র হয়। তবে তাঁর সমর্থকেরা বলছেন, সামাজিক বাস্তবতার কথা যেভাবেই বলা হোক, মূল সমস্যাটি আড়াল করা যায় না। দক্ষিণ এশিয়ায় এখনও বহু মানুষ ধর্মকে কেন্দ্র করেই জীবনযাপন করে, যেখানে শিক্ষার আলো পুরোপুরি পৌঁছায়নি।
তসলিমা নাসরিনের এই মন্তব্য আবারও প্রমাণ করে, ধর্ম ও সমাজ নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সবসময়ই আলোচিত এবং একইসঙ্গে বিতর্কিত। কেউ তাঁর বক্তব্যকে সাহসী সত্য বলছেন, কেউ আবার ধর্মবিদ্বেষী প্রচার। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট— প্রতিবারের মতো এবারও তাঁর কলম সমাজে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।