সিকিম (Sikkim) উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি মনোরম রাজ্য, সম্প্রতি পর্যটকদের জন্য প্রতি ব্যক্তি ৫০ টাকা এন্ট্রি ফি চালু করার ঘোষণা করেছে। এই নতুন নিয়মটি ‘সিকিম রেজিস্ট্রেশন অফ টুরিস্ট ট্রেড রুলস, ২০২৫’-এর অধীনে কার্যকর হয়েছে, যা চলতি মাস থেকে শুরু হয়েছে। এই ফি হোটেলে চেক-ইনের সময় সংগ্রহ করা হবে এবং ‘টুরিজম সাসটেইনেবিলিটি ডেভেলপমেন্ট (টিএসডি) ফান্ড’-এ জমা হবে। এই তহবিলের অর্থ রাজ্যের পর্যটন পরিকাঠামো উন্নয়ন, রাস্তাঘাটের উন্নতি, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং অন্যান্য সেবার জন্য ব্যবহৃত হবে।
এই ফি সকল পর্যটকদের জন্য প্রযোজ্য, তবে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু এবং সরকারি কাজে আগত ব্যক্তিরা এর থেকে অব্যাহতি পাবেন। এই ফি একবার প্রদান করলে ৩০ দিন পর্যন্ত সিকিমে থাকা যাবে। তবে, কেউ যদি ৩০ দিনের পরে রাজ্য ত্যাগ করে আবার ফিরে আসেন, তাহলে তাকে পুনরায় এই ফি দিতে হবে। এই নিয়মের মাধ্যমে সিকিম সরকার পর্যটনের সঙ্গে পরিবেশ রক্ষার ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু জানেন কি, এই ধরনের পর্যটক এন্ট্রি ফি বিশ্বের অনেক দেশেই প্রচলিত? আসুন জেনে নিই এটি কী এবং কেন চালু করা হয়।
সিকিম কেন এই এন্ট্রি ফি চালু করল?
সিকিমের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি পর্যটন শিল্পকে টেকসই করার জন্য এই ফি চালু করা হয়েছে। হিমালয়ের কোলে অবস্থিত এই রাজ্যটি তার অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য, তুষারাবৃত পর্বত, গভীর উপত্যকা এবং শান্ত হ্রদের জন্য বিখ্যাত। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক এখানে আসেন, যা রাজ্যের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পর্যটকদের এই বিপুল ভিড় সিকিমের সূক্ষ্ম পরিবেশ এবং স্থানীয় সংস্কৃতির ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এই ফি-এর মাধ্যমে সরকার পর্যটনের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পরিবেশ সংরক্ষণের ভারসাম্য রাখতে চায়।
এই তহবিল থেকে সংগৃহীত অর্থ নতুন সুবিধা তৈরি, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, রাস্তার উন্নতি এবং পর্যটন পরিকাঠামোর উন্নয়নে ব্যবহৃত হবে। এছাড়া, দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের মাধ্যমে সিকিমের প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা হবে। পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা এই উদ্যোগকে সমর্থন করেছেন। তবে তারা মনে করেন, পর্যটকদের মধ্যে বিভ্রান্তি এড়াতে এই ফি সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য প্রচার করা জরুরি। এজন্য হোটেল, গেস্টহাউস এবং অন্যান্য থাকার জায়গায় ফি-এর তথ্য স্পষ্টভাবে প্রদর্শন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যাতে পর্যটকরা আগমনের আগেই এটি সম্পর্কে জানতে পারেন। এই ফি সিকিমের পর্যটনকে টেকসই সমাধান প্রদান করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পর্যটক এন্ট্রি ফি কী?
পর্যটক এন্ট্রি ফি, যাকে টুরিজম ফি বা টুরিস্ট ট্যাক্সও বলা হয়, হলো পর্যটকদের জন্য একটি অতিরিক্ত চার্জ, যা সাধারণত রাজস্ব সংগ্রহের জন্য ধার্য করা হয়। এই ফি কখনো এয়ারলাইন টিকিটের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকে, আবার কখনো আলাদাভাবে দিতে হয়—অনলাইনে, বিমানবন্দরে বা সমুদ্রবন্দরে পৌঁছে। সিকিমের ক্ষেত্রে এটি হোটেলে চেক-ইনের সময় সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই ধরনের ফি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত, যেমন ভুটান, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স এবং অন্যান্য জায়গায়।
কেন পর্যটক এন্ট্রি ফি ধার্য করা হয়?
পর্যটক এন্ট্রি ফি সংগ্রহের মাধ্যমে স্থানীয় অঞ্চলের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হয়। এই অর্থ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, যার মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিম্নরূপ:
পরিবেশ রক্ষা: জনপ্রিয় পর্যটন স্থানগুলো প্রায়ই পর্যটন থেকে আয়ের সঙ্গে স্থানীয়দের জীবনমান এবং পরিবেশ রক্ষার ভারসাম্য বজায় রাখতে হিমশিম খায়। পর্যটক ফি পরিবেশ ও স্থানীয় সম্প্রদায় রক্ষার খরচ মেটাতে সাহায্য করে, যাতে নিয়ন্ত্রিত পর্যটক সংখ্যার মাধ্যমে আয় অব্যাহত থাকে। সিকিমে এই ফি তার ভঙ্গুর ইকোসিস্টেম রক্ষায় ব্যবহৃত হবে।
নতুন প্রকল্পের জন্য তহবিল: পর্যটন থেকে আয় স্থানীয় প্রকল্পে ব্যবহৃত হয়, যা পর্যটক এবং স্থানীয়দের উভয়ের জন্য উপকারী। উদাহরণস্বরূপ, স্পেনে নতুন পর্যটক ফি জনপ্রিয় স্থানে সাশ্রয়ী আবাসন, রাস্তা এবং বাস সেবার উন্নতিতে ব্যবহৃত হতে পারে। ইতালিতে এই অর্থ স্থানীয় সেবা ও জীবনযাত্রার খরচ কমাতে ব্যবহৃত হয়।
বড় ইভেন্টের প্রস্তুতি: বড় ইভেন্টের আগে পর্যটক ফি বাড়ানো হতে পারে। যেমন, ফ্রান্স ২০২৪ সালের প্যারিস গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের সময় অতিরিক্ত আয়ের জন্য পর্যটক ট্যাক্স বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে।
সিকিমের প্রেক্ষাপটে এর তাৎপর্য
সিকিম ভারতের একটি ছোট রাজ্য হলেও এটি পর্যটনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বত, জাতীয় উদ্যান, এবং সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের জন্য পরিচিত এই রাজ্যে পর্যটকদের আগমন ক্রমশ বাড়ছে। এই ফি-এর মাধ্যমে সরকার পর্যটন পরিকাঠামো উন্নত করার পাশাপাশি পরিবেশ ও সংস্কৃতির ওপর চাপ কমাতে চায়। এটি শুধু স্বল্পমেয়াদি সমাধান নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি টেকসই পর্যটনের পথ প্রশস্ত করবে।
বিশ্বব্যাপী প্রেক্ষাপট
বিশ্বের অনেক দেশ পর্যটন ফি চালু করে টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভুটানে ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ফি’ বিদেশি পর্যটকদের জন্য ধার্য করা হয়, যা পরিবেশ ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। ইউরোপের শহরগুলোতে, যেমন ভেনিস বা আমস্টারডাম, পর্যটক ট্যাক্স পরিচ্ছন্নতা ও ঐতিহ্য রক্ষায় ব্যবহৃত হয়। সিকিমের এই উদ্যোগও এই বিশ্বব্যাপী প্রবণতার অংশ।
সিকিমের ৫০ টাকার পর্যটক এন্ট্রি ফি একটি ছোট পদক্ষেপ হলেও এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। এটি পর্যটনের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদ রক্ষায় সহায়ক হবে। পর্যটকদের অংশগ্রহণে এই তহবিল গড়ে উঠবে, যা সিকিমকে একটি টেকসই পর্যটন গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। পর্যটকদের জন্য এটি একটি সামান্য খরচ হলেও, এর মাধ্যমে তারা সিকিমের সৌন্দর্য রক্ষায় অবদান রাখতে পারবেন। ভবিষ্যতে এই মডেল অন্যান্য ভারতীয় রাজ্যের জন্যও অনুকরণীয় হতে পারে।