আন্তর্জাতিক কূটনীতির উত্তাল সমুদ্রে ফের নতুন তরঙ্গ। একদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘ট্যারিফ বোমা’, অন্যদিকে, ভারত সফরে আসছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন (Putin Set To Visit India)। দুই ঘটনা আপাতভাবে আলাদা হলেও, আসলে জড়িয়ে পড়েছে একটি কেন্দ্রবিন্দুতে, আর তা হল রাশিয়ার তেল।
মস্কো সফরে গিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল জানিয়ে এসেছেন, পুতিন শীঘ্রই ভারত সফর করবেন। রুশ রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম ‘স্পুটনিক’ সূত্রে খবর, অগাস্টের শেষ সপ্তাহেই নয়াদিল্লিতে পা রাখতে পারেন রুশ প্রেসিডেন্ট। এর ঠিক একদিন পরেই হোয়াইট হাউসের তরফে ঘোষণা করা হয় নতুন নির্বাহী আদেশ৷ যেখানে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনার ‘অপরাধে’ ভারতীয় পণ্যের উপর চাপানো হয় ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক।
ভারতকে ‘শাস্তি’ ট্রাম্পের, কারণ রুশ তেলের উপর নির্ভরতা
ট্রাম্পের যুক্তি পরিষ্কার: ভারত রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল আমদানি করছে, তাতে লাভ করছে, আবার সেই তেল খোলা বাজারে রফতানিও করছে। অর্থাৎ যুদ্ধরত রাশিয়ার অর্থনীতিকে অক্ষত রাখতে ভূমিকা নিচ্ছে ভারত। হোয়াইট হাউসের ভাষায়, “এই অবস্থান ইউক্রেন যুদ্ধকে পরোক্ষে সমর্থন করছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা ও বৈদেশিক নীতির পরিপন্থী।”
এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার পর আমেরিকায় ভারতীয় পণ্যের উপর সম্মিলিত শুল্কের হার পৌঁছাল প্রায় ৫০ শতাংশে, যা কোনও এশীয় দেশের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ।
পুতিনের সফর: কৌশলগত বার্তা?
এই অবস্থাতেই পুতিনের ভারত সফরের বার্তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। রাশিয়া-ভারত সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এটি নিছক কূটনৈতিক সৌজন্য নয়, বরং আন্তর্জাতিক চাপের মোকাবিলায় ‘ভূকৌশলগত ঐক্যের’ বার্তা। ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে রাশিয়া ক্রমেই চীনের দিকে ঝুঁকেছে, সেই প্রেক্ষাপটে ভারত-পুতিন বৈঠক চীনের একচেটিয়া প্রভাবকেও ব্যালান্স করতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখতে মস্কোও চাইছে, ভারত যেন আমেরিকার চাপে সম্পর্ক নরম না করে। অন্যদিকে, নয়াদিল্লিও বোঝাতে চাইছে— তার পররাষ্ট্রনীতির চালক বিদেশি চাপ নয়, বরং জাতীয় স্বার্থ।
দুই পরাশক্তির মাঝে ভারতের ‘অসীম কূটনীতি’
বর্তমানে ভারত এক জটিল ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে, পশ্চিমী দুনিয়া চায়, ভারত যেন রাশিয়ার সঙ্গে দুরত্ব রাখে। অথচ রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, সস্তা তেল ও জ্বালানি নির্ভরতা আজও অপরিবর্তিত।
এই পরিস্থিতিতে, ট্রাম্পের হুঁশিয়ারির ঠিক পরপরই পুতিনের সফর সামনে আসা নিঃসন্দেহে পশ্চিমি চাপকে ছাপিয়ে একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির বার্তা। একই সঙ্গে এটি ক্রেমলিনের পক্ষেও আমেরিকার মোকাবিলায় এক কৌশলগত বিজয় বলেই মনে করছে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক মহল।
ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের আগেই ‘ভারত কার পক্ষে’?
এখানে আরেকটি স্পষ্ট সংকেত, খুব শীঘ্রই ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হতে চলেছে। ক্রেমলিন সূত্রে ইঙ্গিত, স্থান নির্ধারিত, প্রস্তুতি চূড়ান্ত। সেই আলোচনার ঠিক আগেই ভারত সফরে পুতিন— একপ্রকার রণনীতিগত স্থাপনাই হয়ে উঠছে তা।
রাশিয়ার পাশে থাকা কি ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে?
প্রশ্ন উঠছে, আগামী দিনে ভারতের রুশ তেল আমদানির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলে, ভারতের তেল সরবরাহ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে? আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে এর চাপ পড়বে দেশের অভ্যন্তরীণ মুদ্রাস্ফীতিতেও। একইসঙ্গে, জিওপলিটিক্যাল চাপে ভারসাম্য রেখে চলাই হবে ভারতের জন্য বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ।