‘মাঁঝি সরকারই আমাদের প্রশাসন’—বলে রেজিস্ট্রেশন মানলেন না ৭৯ আদিবাসী

বাঁকুড়া জেলার মুচিকাটা ও ভেদুয়াশোল গ্রামের বেশ কয়েকজন আদিবাসী বাসিন্দা বিশেষ নিবিড় সংশোধন (Special Intensive Revision বা SIR) প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে অস্বীকার করেছেন। প্রশাসনের পক্ষ…

SIR Enrolment Faces Pushback as 79 Tribals Stand Firm Behind Majhi Sarkar

বাঁকুড়া জেলার মুচিকাটা ও ভেদুয়াশোল গ্রামের বেশ কয়েকজন আদিবাসী বাসিন্দা বিশেষ নিবিড় সংশোধন (Special Intensive Revision বা SIR) প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে অস্বীকার করেছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিকবার সচেতনতার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাঁরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন—তাঁদের আনুগত্য ‘সমাজবাদ ইন্টার-স্টেট মাঁঝি সরকার’-এর প্রতি, ভারত সরকারের প্রতি নয়।

Advertisements

ব্লক প্রশাসন ও পুলিশ–দু’পক্ষই গ্রামে গিয়ে আলোচনা করে আদিবাসী পরিবারগুলিকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে ভোটার তালিকায় নাম তোলা নাগরিক হিসেবে অধিকার, নিরাপত্তা ও সরকারি পরিষেবা পাওয়ার জন্য অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু প্রশাসনের দীর্ঘ প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। গ্রামবাসীদের দাবি, তাঁরা ইতিমধ্যেই মাঁঝি সরকারের কাছ থেকে পরিচয়পত্র নিয়েছেন এবং সেই পরিচয়ই তাঁদের জন্য যথেষ্ট। সরকারি পরিচয় তাঁরা নিতে চান না।

   

প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, এই দুই গ্রামে মোট ৭৯ জন আদিবাসী বাসিন্দা ভোটার তালিকায় নাম তুলতে অস্বীকার করেছেন। কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, বহিরাগত কিছু ব্যক্তি নিজেদের মাঁঝি সরকারের প্রতিনিধি বলে পরিচয় দিয়ে গ্রামবাসীদের বিভ্রান্ত করছেন। তাঁদের প্রভাবেই গ্রামবাসীরা সরকারি রেজিস্ট্রেশন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন বলে ধারণা প্রশাসনের। গ্রামবাসীদের বক্তব্য, তাঁরা মাঁঝি সরকারের নিয়ম মেনে চলেন, এবং তাদের মতে সেটিই তাঁদের প্রকৃত সামাজিক কাঠামো। একজন গ্রামবাসী বলেন, “আমরা দুই পায়ে হাঁটি না। যখন আমরা মাঁঝি সরকারের পরিচয়পত্র নিয়েছি, তখন আর ভারত সরকারের নাগরিক হিসেবে থাকব না।” তাঁর কথায়, নিজেদের নাম মাঁঝি সরকারের তালিকায় তোলার পর সরকারি পরিচয় তাঁদের কাছে অর্থহীন।

এই মন্তব্য প্রশাসনের মধ্যে নতুন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, ভোটার তালিকায় নাম না থাকলে শুধু ভোটাধিকার হারানো নয়—সরকারি প্রকল্প, স্বাস্থ্য পরিষেবা, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প, রেশন এবং নানান সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তা সত্ত্বেও গ্রামবাসীদের একাংশ সিদ্ধান্তে অনড়। অন্যদিকে, প্রশাসন এই অবস্থাকে অত্যন্ত গুরুতরভাবে দেখছে। কারণ, ভারতের সংবিধান অনুযায়ী দেশের প্রতিটি বাসিন্দাকে নাগরিকত্বের অধিকার দেওয়া হয় এবং কোনও সমান্তরাল শাসনব্যবস্থা বা বিকল্প “সরকার” স্বীকৃত নয়। সেই কারণে মাঁঝি সরকারের নামে যে পরিচয়পত্র বিলি করা হয়েছে, তা আইনত মান্যতা পায় না। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য প্রশাসন আবারও গ্রামে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে বলে জানা গেছে।

স্থানীয় সূত্র দাবি করেছে, মাঁঝি সরকার আদিবাসী সামাজিক কাঠামোর একটি প্রথাগত নেতৃত্ব ব্যবস্থা হলেও এর কোনও সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই। এ নিয়ে বহু বছর ধরেই বিভিন্ন অঞ্চলে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কিছু গ্রামে বহিরাগত প্রভাব বা ভুল ব্যাখ্যার কারণে মানুষ সরকারি নথিপত্রের বদলে ঐতিহ্যগত কাঠামোর উপরই নির্ভর করেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিভ্রান্তি দূর করতে হলে আদিবাসী সমাজে আরও গভীর প্রশাসনিক যোগাযোগ, সচেতনতা এবং আস্থা অর্জন জরুরি।

অন্যদিকে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির দাবি, প্রশাসনের নজরদারির অভাব এবং জনসংযোগের ঘাটতির ফলেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যদিও সরকারি দফতর থেকে জানানো হয়েছে—পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ইতিমধ্যেই অতিরিক্ত দল পাঠানো হয়েছে এবং গ্রামবাসীদের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হবে গ্রামের প্রবীণদের একাংশও উদ্বিগ্ন। তাঁরা মনে করছেন, ভুল বোঝাবুঝির কারণে সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলে ভবিষ্যতে সমস্যার মুখে পড়বে গ্রামের মানুষ। বিশেষ করে স্বাস্থ্য পরিষেবা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, বয়স্ক ভাতা, রেশন—এ সব পরিষেবার গুরুত্ব অপরিসীম।

 

Advertisements