উত্তরবঙ্গের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে নতুন গতি আনতে ফের সফরে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার কোচবিহারে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সভায় উপস্থিত হয়ে তিনি রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে গত কয়েক বছরে সম্পন্ন প্রকল্পগুলির খতিয়ান তুলে ধরেন। একই সঙ্গে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও স্পষ্ট করেন। সভায় জেলা প্রশাসনের আধিকারিক, জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন দফতরের শীর্ষ কর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
মুখ্যমন্ত্রী জানান, উত্তরবঙ্গ সরকার গঠনের পর থেকেই তাঁর কাছে বিশেষ গুরুত্বের জায়গা। কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং, কালিম্পং— প্রতিটি জেলায় পরিকাঠামো উন্নয়ন, রাস্তা সম্প্রসারণ, পর্যটন শিল্পের প্রসার, কৃষিজমির সুরক্ষা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবায় উন্নতি— সবক্ষেত্রেই গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য কাজ হয়েছে। তাঁর কথায়, “উত্তরবঙ্গকে উন্নয়নের মূলস্রোতের সঙ্গে যুক্ত করা আমাদের অঙ্গীকার। এই এলাকার মানুষকে আরও ভালো পরিষেবা দেওয়ার জন্য আমরা একটার পর একটা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি।”
সভায় মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সবচেয়ে বেশি চর্চিত অংশ ছিল ডিটেনশন ক্যাম্প ও নাগরিক অধিকারের প্রসঙ্গ। উপস্থিত মানুষ ও কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “বাংলায় ডিটেনশন ক্যাম্প আমি থাকতে দেব না, করতেও দেব না। নমঃশূদ্রসহ সমস্ত সম্প্রদায়কে আমি আশ্বস্ত করছি— আমাদের রাজ্যে কেউ অপমানিত বা অধিকারহীন অবস্থায় থাকতে বাধ্য হবেন না। আমরা চাই মানুষ তাঁর সম্মান-মর্যাদা নিয়ে জীবন যাপন করুক।”
অসমের এনআরসি বা ডিটেনশন ক্যাম্প সংক্রান্ত ভীতি যাতে বাংলার মানুষকে ছুঁতে না পারে— সেই বার্তাই স্পষ্ট করে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর মতে, বাইরে থেকে কোনও প্রশাসনিক সংস্থা বা পুলিশ বাংলার নাগরিকদের চিঠি পাঠানো বা হেনস্থা করার চেষ্টা করলে রাজ্য সরকার তার প্রতিরোধ করবে। তিনি বলেন, “অসমের কোনও অধিকার নেই বাংলার লোককে চিঠি পাঠানোর। আমাদের মানুষকে ভয় দেখানোর চেষ্টা হলে আমরা তা মেনে নেব না। রাজ্যের সম্মান ও নাগরিকের অধিকার রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।” পুলিশ প্রশাসনের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ আরও কড়া। তিনি স্পষ্ট বলেন, “অন্য কোনও রাজ্যের পুলিশ এসে আমার রাজ্যের মানুষকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে পারবে না। যদি কোনও অপরাধীকে ধরতে হয়, তাহলে বাংলার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। আমরা নিশ্চয়ই অপরাধীদের রক্ষা করব না। কিন্তু সাধারণ মানুষ আর অপরাধী এক নয়।” তাঁর ব্যাখ্যা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে মানুষকে ভয় দেখানো বা ভুলভাবে দাগিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বরদাস্ত করা হবে না।
মমতার কথায়, “যে কেউ যে কারও নামে কিছু বলে দিলেই সে অপরাধী হয়ে যায় না। শুধুমাত্র ‘ক্রিমিন্যাল’ বলা মানেই সে অপরাধী— এই দৃষ্টিভঙ্গি ভুল। তদন্ত হবে, প্রমাণ মিলবে, তারপর আইন ব্যবস্থা পদক্ষেপ নেবে। মানুষের ওপর ভুল তকমা লাগিয়ে তাঁদের জীবন দুর্বিষহ করা চলবে না।” তিনি পুলিশকে নির্দেশ দেন— তদন্তে সংযম, মানবিকতা ও আইনগত সততার সঙ্গে কাজ করতে। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে উঠে আসে সরকারি পরিষেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টিও। তিনি জানান, উত্তরবঙ্গে বহু নতুন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মা ও শিশু কল্যাণ প্রকল্প, সেচ ব্যবস্থা, গ্রামীণ সড়ক এবং শিক্ষা-সম্পর্কিত পরিকাঠামো তৈরি হয়েছে। বিশেষত কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ারে কৃষিজাত পণ্য সংগ্রহ ও বিপণনে নতুন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেন— মানুষ কোন সমস্যায় পড়ছেন, কোন সুবিধা পাচ্ছেন না, তা দ্রুত চিহ্নিত করে তার সমাধান করতে হবে। তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য রাজনীতি নয়— মানুষের কল্যাণ। তাই প্রশাসনের কাজ হবে নিরপেক্ষভাবে ও দ্রুততার সঙ্গে মানুষের সমস্যা সমাধান করা।” উত্তরবঙ্গবাসীর উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রীর এই বার্তা যে আগামী দিনের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে, তা নিশ্চিত। তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট— উন্নয়ন যেমন চলবে, তেমনই নাগরিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদার ক্ষেত্রে কোনও আপস করা হবে না।

