গুয়াহাটি: অসম রাজনৈতিক অঙ্গনের নজর এখন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার সাম্প্রতিক মন্তব্যে। আগামী বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির আসন জয়ের সম্ভাবনা, জনসংখ্যাগত কাঠামো, সীমা পুনর্নির্ধারণের (Delimitation) পর নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ এবং ধর্মীয় ভিত্তিতে ভোটব্যাঙ্ক সবকিছু নিয়েই সরাসরি মন্তব্য করেছেন তিনি। দলের উচ্চআত্মবিশ্বাস বজায় রেখেও বাস্তবতার স্বীকারোক্তি তাঁর বক্তৃতায় স্পষ্ট।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আসামে আমরা ১০০-র বেশি আসন জিততে পারব না। এটাই জনসংখ্যার বাস্তব প্যাটার্ন। ১২৬টির মধ্যে আমরা ১০৩টি আসনে লড়তে পারি। তবে এর মানে এই নয় যে বাকি আসনে লড়াই করব না। জনসংখ্যার বিভাজন অনুযায়ী বিজেপি ও আমাদের জোটসঙ্গীরা মিলে মোট ১০৩ আসন পর্যন্তই প্রভাব বিস্তার করতে পারে। আমাদের পদচিহ্ন থাকবে ১০৩টি কেন্দ্রে।”
ইডির তদন্তের মাঝেই সক্রিয় ঝাড়গ্রাম জেলা পুলিশ, গ্রেফতার ৭
তাঁর এই বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে, বিজেপি এবার ভোটের হিসেব কড়াভাবে জনসংখ্যার অনুপাত অনুযায়ী কষছে। আগে যেখানে বিজেপি সর্বোচ্চ ৯০টি আসনে প্রার্থী দিত, সেখানে সীমা পুনর্নির্ধারণের পর নতুন আসনগুলির কারণে ১০–১৫টি অতিরিক্ত আসনে দল গোটা শক্তি নিয়ে নামবে। তাঁর ভাষায়, “Delimitation-এর পর বহু নতুন কেন্দ্র তৈরি হয়েছে, যেখানে বর্তমানে কোনও বিধায়ক নেই। এই জায়গাগুলোতে স্বাভাবিক নিয়মে যুব সমাজ ও মহিলা নেতৃত্বকে সামনে আনা হবে।”
এই মন্তব্য রাজনৈতিক মহলে নতুন আলাপের জন্ম দিয়েছে দল কি এবার প্রার্থী বাছাইয়ে ‘যুব ও মহিলা’ নেতৃত্বকে বড় করে তুলে ধরবে? বিশেষ করে নতুন কেন্দ্রগুলিতে যেখানে বিজেপির সংগঠন অপেক্ষাকৃত নবীন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের দাবি, এতে একদিকে যেমন তরুণ ভোটারকে আকর্ষণ করা সম্ভব হবে, অন্যদিকে বিজেপির নারীভিত্তিক সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচির সুবিধাকেও প্রচারে সামনে আনা যাবে।
তবে বক্তব্যের সবচেয়ে তর্কিত অংশটি ছিল আসামের মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক নিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “বিজেপি আসামিয়া মুসলমানদের ভোট পাবে। কিন্তু ‘মিয়া মুসলিম’দের ভোট পাবে না।” এই মন্তব্য থেকেই পরিষ্কার যে বিজেপি ধর্মীয় পরিচয়ের আরও নির্দিষ্ট শ্রেণিবিভাগ করে এগোচ্ছে। আসামের অসমিয়া ভাষাভাষী মুসলমান এবং মূলত বাংলা ভাষাভাষী ‘মিয়া মুসলিম’ সম্প্রদায়ের নির্বাচন–অভ্যাস ও রাজনৈতিক ঝোঁকের মধ্যে স্পষ্ট ভেদরেখা টানতে চাইছে দল।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মত, বিজেপির লক্ষ্য এবার আগের তুলনায় আরও নির্ভুল ‘মাইক্রো টার্গেটিং’। মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে খোলাখুলি ভোট–কৌশল ব্যাখ্যা করেছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে বিজেপি কোন অঞ্চলে, কোন সম্প্রদায়ের উপর বেশি জোর দেবে, আর কোথায় লড়াই অপেক্ষাকৃত দুরূহ তার হিসেব এখনই স্পষ্ট।
এখন প্রশ্ন উঠছে “১০৩ আসনে পদচিহ্ন” থাকার কথা বলে আসলে কী বার্তা দিতে চাইছে বিজেপি? রাজনৈতিক বিশ্লেষণের অভিমত, এটি ভোট পরবর্তী সম্ভাব্য ফলাফলকে ধরে আগাম বাস্তববাদী স্বর তৈরি করা, যাতে নির্বাচনের পরে ফলাফল নিয়ে কোনও অস্বস্তি তৈরি না হয়। একইসঙ্গে এমন বার্তা দেওয়া যেখানে জয়ের বাস্তব সম্ভাবনা আছে, সেখানে পূর্ণ শক্তি অন্য জায়গায় প্রয়োজনীয় উপস্থিতি।
রাজনীতিতে জনসংখ্যাগত রেখাচিত্রকে কেন্দ্র করে ভোট–কৌশল নতুন কিছু নয়। তবে মুখ্যমন্ত্রী শর্মা যেভাবে তা খোলাখুলি জানিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে আগামী নির্বাচনের আগে বড় রাজনৈতিক বার্তা। পাশাপাশি, ‘আসামিয়া মুসলমান বনাম মিয়া মুসলিম’ শব্দবন্ধের ব্যবহার ভবিষ্যতে রাজ্যের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে আরও তীব্র বিতর্কের জন্ম দিতে পারে এমন মতও বহু বিশ্লেষকের।
এখন দেখার বিষয়, বিজেপির ‘১০৩ আসন ভিত্তিক লক্ষ্য–রূপরেখা’ নির্বাচনের মাঠে কতটা সফল হয় এবং বিরোধীরা এই সূক্ষ্ম ভোট–কৌশলের জবাব কেমন দেয়। অসমের রাজনীতির উত্তাপ এখন চরমে, আর হিমন্ত বিশ্ব শর্মার বক্তৃতা তাতে আরও নতুন অধ্যায়ের আভাস দিল নিঃসন্দেহে।
