গুয়াহাটি: অসমের সমাজ কাঠামোতে বড় পরিবর্তনের পথে এগিয়ে গেল হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সরকার। মঙ্গলবার অসম বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং পেশ করলেন ‘অসম বহুবিবাহ নিষিদ্ধকরণ বিল’, যা রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চলে বহুবিবাহকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করবে। বিলটি পেশের পরই রাজনৈতিক মহলে তুমুল আলোচনার ঝড় উঠেছে।
স্পিকার বিশ্বজিৎ দাইমারির অনুমতি সাপেক্ষে মুখ্যমন্ত্রী যখন বিলটি পেশ করেন, ঠিক সে সময়ই বিরোধী পক্ষের সদস্যরা তীব্র আপত্তি জানিয়ে ওয়াকআউট করেন। কংগ্রেস, সিপিআই (এম) এবং রাইজোর দলের বিধায়করা দাবি করেন—এই বিলটি হঠাৎ করে আনা হয়েছে এবং সমাজে বিভাজন বাড়াতে পারে। তবে সরকার মনে করছে, এটি একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং সমাজে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ।
সরকারি বিবৃতিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে কোনও ব্যক্তি, যার স্ত্রী বা স্বামী জীবিত আছেন এবং আইনত বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি, তিনি পুনরায় বিয়ে করতে পারবেন না। এর অর্থ, পরকীয়া বা গোপন বিয়ে এখন থেকে শুধু সামাজিক অপরাধ নয়, আইনগত গুরুতর অপরাধও হবে।
বিল অনুযায়ী, বহুবিবাহ করলে সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। আর যদি কেউ আগের বিয়ে গোপন করে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিয়ে করেন, তবে শাস্তি আরও কঠোর সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত জেল এবং মোটা অঙ্কের জরিমানা। শুধু তাই নয়, এই প্রক্রিয়ায় যাঁরা সহায়তা করবেন হোক তিনি কাজি, পুরোহিত, গ্রামপ্রধান, পরিবার সদস্য বা আইনি অভিভাবক তাঁরাও আইনের জালে ধরা পড়বেন।
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেন “অসমে বহুবিবাহের অপব্যবহার বহু দিন ধরেই সমাজে অশান্তি, বৈষম্য ও বিশেষত নারীদের জীবনে দুর্দশা বাড়িয়েছে। আমরা একটি বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে চাই। তাই এই বিল সময়ের দাবি।” উল্লেখযোগ্যভাবে, প্রস্তাবিত বিলটি ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত এলাকা বাদে গোটা অসমে প্রযোজ্য হবে। কারণ, ওইসব এলাকায় উপজাতীয় সংস্কৃতি ও সামাজিক নিয়ম ভিন্ন হওয়ায় সেখানে বিশেষ স্বায়ত্তশাসনের অধীনে আলাদা আইন চালু রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই বিলের মাধ্যমে অসম সরকার ব্যক্তিগত আইন সংস্কারের দিকে বড় পদক্ষেপ নিল। বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, এটি ভবিষ্যতে ইউনিফর্ম সিভিল কোড (UCC)-এর পথকেও আরও মসৃণ করবে। যদিও বিরোধীরা অভিযোগ করছেন—এই বিলের লক্ষ্য ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটানো।
বিলটি পেশ হওয়ার পর সাধারণ মানুষের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। নারী অধিকারকর্মীদের একাংশ এই সিদ্ধান্তকে “ঐতিহাসিক” বলে প্রশংসা করেছেন। তাঁদের দাবি, অসমে বহুবিবাহের ফলে বহু নারী আর্থিক ও মানসিক অত্যাচারের শিকার হন, এবং অপরাধীরা শাস্তি এড়াতে সক্ষম হন। এই বিল তা রোধ করতে সাহায্য করবে।
অন্যদিকে, বিরোধী শিবিরের অভিযোগ—সরকার ভোটের রাজনীতি করছে এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। যদিও মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বারবারই স্পষ্ট করেছেন যে এই আইন কোনও ধর্ম বা সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে নয়, বরং অসমের নাগরিকদের জন্য “এক আইন, এক ব্যবস্থা” তৈরি করাই এর উদ্দেশ্য।
বিলটি এখন বিস্তারিত আলোচনার জন্য পাঠানো হবে এবং আইনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তা কার্যকর হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এর মাধ্যমে অসম সরকার ব্যক্তিগত আইন সংস্কারে দেশের অন্যতম অগ্রণী রাজ্য হয়ে উঠতে পারে—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
