নয়াদিল্লি: ভারত–আমেরিকা সম্পর্ক এখন এক উত্তেজক মোড়ে দাঁড়িয়ে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসন ভারতের উপরে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক চাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কূটনৈতিক অঙ্গনে এই সিদ্ধান্ত ধরা পড়ছে একপ্রকার ‘চাপের কৌশল’ হিসেবে, যার মূল লক্ষ্য রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক ও কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা দুর্বল করা (PM Modi-s Diplomacy For Trump)।
কিন্তু ট্রাম্প যখন এই শুল্ক–বিস্ফোরণ ঘটালেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তখন ‘ব্রত’ নিলেন সংযমের। ফোন করেননি ট্রাম্পকে। বরং প্রায় এক ঘণ্টা ধরে কথা বললেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভার সঙ্গে। দুই নেতার আলোচনার কেন্দ্রে ছিল, কীভাবে ওয়াশিংটনের বেআব্রু শুল্ক নীতির বিরুদ্ধে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলি ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। অর্থাৎ, সংঘাতে না গিয়ে মোদী বেছে নিচ্ছেন সম্মিলিত প্রতিরোধের পথ।
একই দিনে এক অনুষ্ঠানে মোদী সাফ জানিয়ে দেন, “ভারতীয় কৃষকদের স্বার্থের প্রশ্নে কোনও রকম আপস নয়, even if I have to pay a heavy price.” এই বার্তা স্পষ্টতই ট্রাম্পের উদ্দেশে, যিনি মার্কিন কৃষি ও দুগ্ধ শিল্পের জন্য ভারতের বাজার ‘খুলে’ দিতে চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন।
অন্যদিকে, যখন হোয়াইট হাউজ থেকে অতিরিক্ত শুল্ক চাপানোর ঘোষণা আসে, তখনই রাশিয়ার মাটিতে পা রাখছেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। সেখান থেকেই তিনি ঘোষণা করেন, “ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফরের দিন প্রায় চূড়ান্ত।” এমন একটি সময়ে এই বার্তা ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে এক রীতিমতো কৌশলগত পাল্টা পদক্ষেপ।
চলতি মাসের শেষেই মস্কো সফরে যাচ্ছেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। ১ সেপ্টেম্বর শাংঘাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (SCO)-এর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে বেজিং যাচ্ছেন স্বয়ং মোদী—যেখানে পুতিন এবং চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিংয়ের সঙ্গেও তাঁর দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হতে পারে।
ওয়াশিংটনের দৃষ্টিতে এই সমস্ত কৌশলিক যোগাযোগ হয়তো ‘বিরক্তিকর’। কিন্তু দিল্লির অবস্থান স্পষ্ট: “কূটনীতি আপসের নয়, আত্মমর্যাদার।” বৃহস্পতিবার রাতেই ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা বন্ধ রাখা হবে যতক্ষণ না রুশ তেল কেনার ইস্যু ‘মিটে না’। এর জবাবে দিল্লির বার্তা, ভারতের কৃষি, দুগ্ধ এবং মৎস্য খাতকে মার্কিন দখলের অধীনে ঠেলে দিয়ে কোনও চুক্তি হবে না।
২০২০–র কৃষক আন্দোলনের স্মৃতি এখনও স্পষ্ট। সেসময় তিন কৃষি বিল ঘিরে প্রবল ক্ষোভ দেখা দেয়, যা ২০২১–এ প্রত্যাহার করতে হয়। সেই প্রেক্ষাপটেই কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে মোদী যেন এখন ফের প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন, “আমি কৃষকদের আসল রক্ষক”। একদিকে বছরে ৬ হাজার টাকা সহায়তা, ফসল বিমা, অন্যদিকে আমেরিকার চোখ রাঙানির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, এই দুই মেরুর মধ্যে সমীকরণ তৈরি করছেন তিনি।
গত ১০০ দিনে মোদী ও ট্রাম্পের মধ্যে মাত্র দু’বার টেলিফোনে কথা হয়েছে। একবার এপ্রিলের পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার পরে, আর একবার জুনে, যখন ট্রাম্প ফোন করেছিলেন মোদীর কানাডা সফরের সময়। সেখানেও মোদী সরাসরি খণ্ডন করেন ট্রাম্পের সেই বিতর্কিত দাবি, যে তিনি নাকি ভারত–পাক অস্ত্রবিরতি ‘মধ্যস্থ’ করেছেন। এই ‘অত্যন্ত ব্যক্তিগত প্রত্যাখ্যান’ও ওয়াশিংটনের চক্ষুশূল হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক মহলের ধারণা।
বর্তমানে ভারত কৌশলগতভাবে ‘বন্ধুদের পাশে দাঁড়ানো’ এবং ‘সময়কে কাজে লাগানো’র পথে হাঁটছে। আমেরিকার আচরণকে ‘অন্যায্য, অযৌক্তিক ও দুর্ভাগ্যজনক’ বলে কড়া বিবৃতি দিয়েছে বিদেশ মন্ত্রক, যা সাম্প্রতিক দশকে ওয়াশিংটনের প্রতি ভারতের সবচেয়ে কঠিন বক্তব্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি ট্রাম্প–পুতিন সাক্ষাৎ হয় এবং রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ কোনও রকমে মীমাংসা পায়, তাহলে হোয়াইট হাউসের ভারত–বিরোধিতা নিমেষে উবে যেতে পারে। কারণ, এক সময় আমেরিকাই ভারতকে রুশ তেল কেনার পরামর্শ দিয়েছিল। এমনকী, আজও যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া থেকে ইউরেনিয়াম আমদানি করে।
সুতরাং, মোদীর বার্তা একটাই—বাণিজ্য চুক্তি তখনই হবে, যখন তা হবে ‘জাতীয় স্বার্থে’ এবং কৃষকের স্বার্থে আপস ছাড়াই। এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার সংসদে মোদীর কৃষকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এই সংকেতই দেয়, “সংঘাত নয়, আত্মবিশ্বাসই ভারতের উত্তর।”