ওড়িশার ফকির মোহন (Congress Leader) কলেজের এক ২০ বছর বয়সী ছাত্রীর আত্মহননের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজ্যে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে কংগ্রেসের নেতৃত্বে আটটি বিরোধী দল আজ ওড়িশা জুড়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্ধের ডাক দিয়েছে। এই বন্ধের সময় ভুবনেশ্বরে বিক্ষোভ চলাকালীন পুলিশ ওড়িশা কংগ্রেসের ইন-চার্জ আজয় কুমার লাল্লুসহ বেশ কয়েকজন বিরোধী নেতা ও কর্মীকে আটক করেছে।
বিরোধীরা এই ঘটনাকে ‘প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা’ বলে অভিহিত করে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী সূর্যবংশী সুরজের পদত্যাগ এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছে। বালাসোরের ফকির মোহন অটোনোমাস কলেজের ইন্টিগ্রেটেড বি.এড কোর্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন ওই তরুণী। তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে, কলেজের শিক্ষা বিভাগের প্রধান সমীর কুমার সাহু তাঁর প্রতি বারবার যৌন হয়রানি করেছেন এবং প্রত্যাখ্যান করলে তাঁকে পরীক্ষায় ফেল করার হুমকি দিয়েছেন।
তিনি এই বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ দিলীপ ঘোষ, জেলা প্রশাসন, পুলিশ এবং এমনকি মুখ্যমন্ত্রী মোহন চরণ মাঝি ও কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধানের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর অভিযোগের কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে তিনি ১২ জুলাই কলেজ ক্যাম্পাসে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন।
৯৫ শতাংশ পোড়া অবস্থায় তাঁকে প্রথমে বালাসোর জেলা হাসপাতালে এবং পরে ভুবনেশ্বরের এইমস-এ ভর্তি করা হয়। দুর্ভাগ্যবশত, ১৪ জুলাই রাতে তিনি মারা যান। এই ঘটনার পর কলেজের অধ্যক্ষ দিলীপ ঘোষ এবং বিভাগীয় প্রধান সমীর কুমার সাহুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ওড়িশা বন্ধ ও বিক্ষোভ
কংগ্রেস, বিজু জনতা দল (বিজেডি), সিপিআই, সিপিআই(এম), সিপিআই(এমএল), ফরওয়ার্ড ব্লক, আরজেডি এবং এনসিপি-সহ আটটি বিরোধী দল এই ঘটনার প্রতিবাদে ১৭ জুলাই ওড়িশা বন্ধের ডাক দেয়। বন্ধের ফলে ভুবনেশ্বর, কটক, রাউরকেলা, বালাসোর, ভদ্রক এবং ময়ূরভঞ্জের মতো এলাকায় জনজীবন ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়।
দোকানপাট, পেট্রোল পাম্প, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। চেন্নাই-কলকাতা হাইওয়েতে ব্যাপক যানজট দেখা যায়, যেখানে ট্রাক এবং অন্যান্য যানবাহন আটকে থাকে। ভুবনেশ্বরের জয়দেব বিহার, খণ্ডগিরি এবং সিআরপি স্কোয়ারে বিক্ষোভকারীরা রাস্তা অবরোধ করে এবং টায়ার জ্বালিয়ে স্লোগান দেয়। সরকারি ও বেসরকারি বাস পরিষেবাও বন্ধ ছিল।
ওড়িশা কংগ্রেসের ইন-চার্জ আজয় কুমার লাল্লু ভুবনেশ্বরে বিক্ষোভের সময় বলেন, “ওড়িশার এই কন্যার জন্য ন্যায়বিচারের দাবিতে কংগ্রেস রাস্তায় নেমেছে। এই ঘটনায় গোটা দেশ লজ্জিত। বিজেপির ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং টিম কোথায়? মুখ্যমন্ত্রী মোহন চরণ মাঝি এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধানকে পদত্যাগ করতে হবে।” তিনি আরও অভিযোগ করেন, রাজ্য সরকার ন্যায়বিচার দিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং বিক্ষোভ দমনের জন্য পুলিশি হিংস্রতার আশ্রয় নিয়েছে। ভুবনেশ্বরে পুলিশ লাল্লুসহ বেশ কয়েকজন বিরোধী নেতা ও কর্মীকে আটক করে, যা বিক্ষোভকে আরও উত্তপ্ত করে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এই ঘটনাকে ‘বিজেপির ব্যবস্থার দ্বারা সংগঠিত হত্যা’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি ছাত্রীর বাবার সঙ্গে কথা বলে পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান এবং ন্যায়বিচারের আশ্বাস দেন। তিনি এক্স-এ লিখেছেন, “ওড়িশায় ন্যায়ের জন্য লড়াই করা এক কন্যার মৃত্যু বিজেপির ব্যবস্থার হত্যার সমান। তিনি যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন, কিন্তু ন্যায়ের পরিবর্তে তাঁকে হুমকি, নির্যাতন এবং অপমানের শিকার হতে হয়েছে।”
বিজেডি নেতা ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কও এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন এবং রাজ্য সরকার ও পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের উপর বলপ্রয়োগের অভিযোগ তুলেছেন। বিজেডি ১৬ জুলাই বালাসোরে একটি পৃথক বন্ধের ডাক দেয়, যা সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত পালিত হয়।
প্রখর রোদে শুকিয়ে যাচ্ছে জমি, চাষ নিয়ে চরম বিপদে উত্তরবঙ্গের কৃষকরা
সরকারের প্রতিক্রিয়া
ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী মোহন চরণ মাঝি এই ঘটনাকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে উল্লেখ করে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমি পরিবারকে আশ্বাস দিচ্ছি, দোষীরা আইন অনুযায়ী কঠোরতম শাস্তি পাবে।” রাজ্য সরকার ছাত্রীর পরিবারের জন্য ২০ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে এবং একটি উচ্চ-পর্যায়ের বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়া, ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন (ইউজিসি) এই ঘটনার তদন্তের জন্য একটি চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
জনজীবনে প্রভাববন্ধের ফলে ওড়িশার জনজীবন ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। ভুবনেশ্বর, কটক, ভদ্রক এবং ময়ূরভঞ্জে রাস্তাঘাট প্রায় জনশূন্য ছিল। পেট্রোল পাম্প, বাজার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্ম ব্যাহত হয়। তবে, জরুরি পরিষেবা যেমন অ্যাম্বুলেন্স, চিকিৎসা সুবিধা এবং ওষুধের দোকান বন্ধের আওতার বাইরে রাখা হয়েছিল।
ফকির মোহন কলেজের ছাত্রীর আত্মহননের ঘটনা ওড়িশার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী নিরাপত্তা এবং প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতার গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। আজয় কুমার লাল্লুসহ বিরোধী নেতাদের আটক এই বিক্ষোভকে আরও জোরালো করেছে।
বিরোধী দলগুলির দাবি, এই ঘটনা শুধু একটি মর্মান্তিক ঘটনা নয়, বরং রাজ্যে নারীদের প্রতি ক্রমবর্ধমান অত্যাচারের প্রতিফলন। আগামী দিনে এই ঘটনার তদন্ত এবং সরকারের পদক্ষেপ ওড়িশার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।