ভারতের সবচেয়ে কুখ্যাত অবৈধ অস্ত্র সরবরাহকারী শেখ সলিম ওরফে ‘সেলিম পিস্তল’-কে (Selim)নেপালে গ্রেফতার করা হয়েছে। শনিবার পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, দিল্লি পুলিশের বিশেষ সেল এবং ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলি নেপাল পুলিশের সঙ্গে যৌথ অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করেছে।
দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তান থেকে ভারতে অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করে আসা সেলিম পিস্তলের গ্রেফতারি ভারতের অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার বিরুদ্ধে একটি বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তদন্তকারীদের হাতে তার পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং কুখ্যাত অপরাধী দাউদ ইব্রাহিমের ডি-কোম্পানির সঙ্গে যোগসূত্রের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সেলিম পিস্তলের অপরাধ জগৎ
দিল্লির সীলমপুরের বাসিন্দা শেখ সলিম, যিনি ‘সেলিম পিস্তল’ নামে পরিচিত, তার অপরাধ জীবন শুরু হয়েছিল ২০০০ সালে গাড়ি চুরির মাধ্যমে। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে অষ্টম শ্রেণির পর পড়াশোনা ছেড়ে তিনি প্রথমে গাড়ির চালক হিসেবে কাজ করেন।
২০০০ সালের ৭ এপ্রিল চাঁদনি চক থেকে একটি মারুতি ভ্যান চুরির ঘটনায় তিনি তার সহযোগী মুকেশ গুপ্ত ওরফে ‘কাকা’র সঙ্গে ধরা পড়েন। ২৫ মে, ২০০০ তারিখে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির (আইপিসি) ৩৭৯, ৪১১ এবং ৩৪ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়।
২০১১ সালের ৭ আগস্ট জাফরাবাদে ২০ লাখ টাকার একটি সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনায় তার নাম জড়ায়। ২০১৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেফতার করে বিচারবিভাগীয় হেফাজতে পাঠানো হয় এবং আইপিসির ৩৯৫ ও ৩৯৭ ধারায় অভিযুক্ত করা হয়। এরপর ২০১৮ সালে তাকে দিল্লি পুলিশ গ্রেফতার করে, কিন্তু জামিনে মুক্তি পেয়ে তিনি বিদেশে পালিয়ে যান।
অস্ত্র সরবরাহের নেটওয়ার্ক
সেলিম পিস্তল দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তান থেকে ভারতে অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করে আসছিলেন। তিনি ভারতে প্রথম জিগানা পিস্তল সরবরাহকারী হিসেবে পরিচিত। এই পিস্তলগুলি তুরস্কে তৈরি এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় অস্ত্র, যা ভারতের গ্যাংস্টারদের কাছে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সেলিম পাকিস্তান থেকে নেপাল হয়ে অস্ত্র ভারতে পাচার করতেন। অস্ত্রগুলি আলাদা অংশে বিভক্ত করে গাড়ির গোপন কম্পার্টমেন্টে লুকিয়ে আনা হতো এবং ভারতে পৌঁছে পুনরায় জোড়া দেওয়া হতো। একটি জিগানা পিস্তলের বাজার মূল্য প্রায় ৬ লাখ টাকা, এবং ড্রোনের মাধ্যমে আনা অস্ত্রের দাম প্রায় ৪ লাখ টাকা।
সেলিম লরেন্স বিষ্ণোই, হাশিম বাবা এবং অন্যান্য কুখ্যাত গ্যাংস্টারদের অস্ত্র সরবরাহ করতেন। তার নাম পাঞ্জাবি গায়ক সিধু মুসেওয়ালার হত্যাকাণ্ড এবং প্রাক্তন মহারাষ্ট্র মন্ত্রী বাবা সিদ্দিকীর হত্যাকাণ্ডের তদন্তে উঠে এসেছে। তিনি মুসেওয়ালা হত্যাকাণ্ডের একজন অভিযুক্তের পরামর্শদাতা হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছেন।
গ্রেফতারির পটভূমি
২০১৮ সালে জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর সেলিম বিদেশে পালিয়ে যান এবং নেপালে আত্মগোপন করেন। সম্প্রতি গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় যে তিনি নেপালে আছেন। এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দিল্লি পুলিশের বিশেষ সেল এবং ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলি নেপাল পুলিশের সঙ্গে যৌথ অভিযান চালায় এবং তাকে গ্রেফতার করে।
অপরাধ জগতের উপর প্রভাব
সেলিম পিস্তলের গ্রেফতারি ভারতের অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার বিরুদ্ধে একটি বড় ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তার নেটওয়ার্ক ভারত ও পাকিস্তান জুড়ে বিস্তৃত ছিল, এবং তিনি কোটি কোটি টাকার অস্ত্র সরবরাহ করেছেন।
পুলিশ এখন তার পাকিস্তানের আইএসআই এবং ডি-কোম্পানির সঙ্গে যোগসূত্র, সেইসঙ্গে একাধিক হত্যাকাণ্ড ও অস্ত্র পাচারের ঘটনায় তার ভূমিকা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তাকে ভারতে প্রত্যর্পণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
‘ইঞ্জিনিয়ারিং যান’ পেল ভারতীয় সেনা, যা যুদ্ধক্ষেত্রে সহজ করবে পথ
সেলিমের ব্যক্তিগত প্রোফাইল
১৯৭২ সালে জন্মগ্রহণকারী শেখ সেলিমের পিতার নাম মোহাম্মদ শরিফ। জাফরাবাদের বাসিন্দা সেলিমের পরিবারে পাঁচ ভাই, দুই বোন, স্ত্রী এবং এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ১৯৯২ সালে তার বিয়ে হয়। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে পড়াশোনা ছেড়ে তিনি অপরাধ জগতে প্রবেশ করেন।
সেলিম পিস্তলের গ্রেফতারি ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য। তার পাকিস্তান-নেপাল-ভারত অস্ত্র পাচার নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়ার এই অভিযান অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি মাইলফলক।
পুলিশ এখন তার নেটওয়ার্কের অন্যান্য সদস্যদের চিহ্নিত করতে তদন্ত জোরদার করছে। ভোক্তা এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলি আশা করছে, এই গ্রেফতারি অপরাধ জগতের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে।