নেলির ক্ষত আবারও খুলছে: তিওয়ারি রিপোর্টে অসমে অশান্তির আশঙ্কা

After 42 years, Assam govt to table the Tiwari Commission Report on the 1983 Nellie Massacre in the upcoming assembly session. The move sparks debates on justice, history, and fears of fresh communal unrest.

অসমের রাজনৈতিক আবহ আবারও তপ্ত। প্রায় চার দশক আগে ঘটে যাওয়া রক্তাক্ত নেলি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত রিপোর্ট অবশেষে প্রকাশ করতে চলেছে রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ঘোষণা করেছেন, নভেম্বরের বিধানসভা অধিবেশনে তিওয়ারি কমিশনের ৫৫১ পাতার রিপোর্ট তলায় পেশ করা হবে। এই ঘোষণার পরই পুরনো ক্ষত যেন আবারও জেগে উঠেছে, রাজ্যজুড়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক।

Advertisements

১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ভোর। মাত্র ছয় ঘণ্টার মধ্যে মরিগাঁও জেলার নেলি ও আশপাশের গ্রামে রক্তস্নান। সরকারি হিসাবে নিহতের সংখ্যা ছিল ২,১৯১, কিন্তু স্থানীয়রা দাবি করেন—সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়েছিল। নারী, শিশু, বৃদ্ধ—কারও প্রাণ রক্ষা হয়নি। সেই দিনটি ইতিহাসে চিহ্নিত হয়েছে স্বাধীনোত্তর ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞগুলির মধ্যে একটি হিসেবে।

   

ঘটনার পর ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে গঠিত হয়েছিল তিওয়ারি কমিশন। ১৯৮৪ সালে রিপোর্ট জমা দিলেও তৎকালীন সরকার তা গোপন রাখে, যুক্তি ছিল—“প্রকাশ করলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ফের বাড়তে পারে।” অবশেষে ৪২ বছর পর মুখ্যমন্ত্রী শর্মার সিদ্ধান্তে প্রকাশ হতে চলেছে সেই রিপোর্ট। তিনি স্পষ্ট বলেছেন—“অসমবাসীর জানার অধিকার আছে। ইতিহাস চেপে রাখা অন্যায়।”

তবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনৈতিক মহলে মতভেদ তীব্র। বিরোধী নেতা দেবব্রত শইকিয়া প্রশ্ন তুলেছেন—“যে ক্ষত এতদিনে শুকিয়েছিল, সেটিকে আবার খোঁচানো হচ্ছে কেন? এর উদ্দেশ্য কি নির্বাচনের আগে জনমানসে উত্তেজনা ছড়ানো?” তাঁর মতে, নেলি অঞ্চলে সব সম্প্রদায় এখন শান্তিতে বাস করছে। এই রিপোর্ট প্রকাশের সিদ্ধান্ত সেই সম্প্রীতিকে নষ্ট করতে পারে।

অন্যদিকে, অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (AASU) রিপোর্ট প্রকাশকে সমর্থন করেছে। সংগঠনের সভাপতি উৎপল শর্মা বলেন, “৪০ বছর ধরে এত গুরুত্বপূর্ণ নথি গোপন রাখা ভুল ছিল। জনগণের জানার অধিকার আছে।” তবে তিনি আশঙ্কাও প্রকাশ করেন—“জুবিন গার্গের মৃত্যুর ন্যায়বিচারের দাবিটি যেন আড়ালে চাপা না পড়ে।”

Advertisements

চলচ্চিত্র নির্মাতা পার্থজিত বরুয়া, যিনি The Nellie Story ছবি নির্মাণ করেছেন, এই পদক্ষেপে হতাশ। তাঁর কথায়, “অসম এখনো জুবিন গার্গের মৃত্যুশোকে স্তব্ধ। এই সময়ে তিওয়ারি রিপোর্ট প্রকাশের সিদ্ধান্ত অপ্রত্যাশিত। এতে মানুষের ঐক্য ভাঙতে পারে।”

ইতিহাসবিদ ও গবেষকরা মনে করেন, নেলি হত্যাকাণ্ড কেবল একটি ‘massacre’ নয়, বরং প্রকৃত অর্থেই একটি ‘genocide’। আইআইটি বোম্বের অধ্যাপিকা জাবিন ইয়াসমিন তাঁর গবেষণায় লিখেছেন, “আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্য ছিল একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করা।” সেই কারণে নেলি কেবল অসম নয়, গোটা ভারতের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়।

সরকারি সূত্রে জানা গেছে, রিপোর্টে প্রশাসনিক ব্যর্থতার একাধিক দৃষ্টান্ত উঠে এসেছে। আক্রমণের আগে স্থানীয় প্রশাসন সতর্কতা পেলেও তা গুরুত্ব দেয়নি। সেনা ও পুলিশের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত দেরি ও অপর্যাপ্ত। ফলে প্রশ্ন উঠছে—এই রিপোর্ট কি কেবল অতীতের ইতিহাস, না কি বর্তমান প্রশাসনিক দায়বদ্ধতারও প্রতিচ্ছবি?

সব মিলিয়ে, নেলি হত্যাকাণ্ডের ৪২ বছর পর রিপোর্ট প্রকাশের এই সিদ্ধান্তকে কেউ দেখছেন ইতিহাসের মুখোমুখি হওয়ার সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে, আবার কেউ আশঙ্কা করছেন—এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে নতুন বিভাজন তৈরি করবে। সত্যিই কি অতীতের দগ্ধ ক্ষত আবারও জেগে উঠবে? যে অধ্যায় ইতিহাস বহুদিন আগে বন্ধ করেছিল, তা কি আবারও খুলতে চলেছে? অসম আজ সেই ভয়, প্রশ্ন আর অসমাপ্ত ন্যায়বিচারের প্রতিধ্বনিতে কাঁপছে।