আজকের দিনে যখন ভারতের বিভিন্ন শহর বসবাসযোগ্যতার (Livable Cities India) তালিকায় সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন পশ্চিমবঙ্গের কোনও শহরই সেই তালিকায় স্থান পায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত গভীরন্ত্রিত “ইজ অফ লিভিং ইন্ডেক্স ২০২০”-এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতের শীর্ষ ১০ বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় বেঙ্গালুরু (৬৬.৭), পুনে (৬৬.২৭), আহমেদাবাদ (৬৪.৮৭) এবং চেন্নাই (৬২.৬১) সহ অন্যান্য শহর রয়েছে, তবে কলকাতা বা অন্য কোনও বাংলা শহর এই তালিকায় নেই। এই বিষয়টি বাঙালি সমাজে উদ্বেগ এবং আলোচনার কারণ হয়ে উঠেছে। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা এই তথ্যের পেছনে লুকিয়ে থাকা কারণগুলো বিশ্লেষণ করব এবং কলকাতার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করব।
ইজ অফ লিভিং ইন্ডেক্স ২০২০: কীভাবে তৈরি হয়?
“ইজ অফ লিভিং ইন্ডেক্স” হলো ভারতের শহরী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের তৈরি একটি বার্ষিক প্রতিবেদন, যা শহরগুলোর জীবনযাপনের গুণমান মূল্যায়ন করে। এই তালিকা প্রস্তুত করার জন্য পাঁচটি প্রধান ক্ষেত্র বিবেচনা করা হয়—অর্থনৈতিক ক্ষমতা, স্থিতিশীলতা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি, পরিবেশ এবং ভিত্তিস্থাপনা। ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, যেহেতু এটি ২০২১ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয়েছিল, তাই এর মানদণ্ড বর্তমানের চিত্রকে পুরোপুরি প্রতিফলিত করতে পারে না। এই তালিকায় শুধুমাত্র ১০ লক্ষের বেশি জনসংখ্যার শহরগুলোকে বিবেচনা করা হয়েছে, যা কলকাতার মতো ঐতিহাসিক শহরের জন্য একটি বড় প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে।
কলকাতার অবস্থা: একটি ঐতিহাসিক শহরের পতন
কলকাতা এক সময় ভারতের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষাগত কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। ব্রিটিশ আমলের পর থেকে এই শহরটি শিল্প, বাণিজ্য এবং শিল্পকলার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। তবে স্বাধীনতা উত্তরে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং শিল্পের অবনতি এই শহরের অবস্থাকে প্রভাবিত করেছে। ১৯৭০-এর দশকে শিল্প কারখানাগুলো বন্ধ হওয়া এবং পেশাদারদের অন্য শহরে চলে যাওয়া কলকাতার অর্থনৈতিক পতনের প্রধান কারণ ছিল। ফলে মুম্বই এবং পরবর্তীতে বেঙ্গালুরু এবং পুনে এই শহরের অবস্থান অধিকার করেছে।
বর্তমানে কলকাতার জীবনযাপনের গুণমান নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনা রয়েছে। “নাম্বিও” এর মতো প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, কলকাতার জীবনযাপনের মান আকর্ষণীয় না হলেও এর খরচ কম এবং নিরাপত্তা তুলনামূলকভাবে ভালো। তবে সেবার গুণমান এবং আয়ের সীমিততা এই শহরকে “লিভিং হেল” হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই অবস্থা তালিকায় কলকাতার অনুপস্থিতির একটি বড় কারণ হতে পারে।
বেঙ্গালুরু ও পুনের সফলতা: কী শিখব?
বেঙ্গালুরু, যাকে “সিলিকন ভ্যালি অফ ইন্ডিয়া” বলা হয়, ২০২৪ সালে ৬৬.৭০ স্কোর পেয়ে শীর্ষে রয়েছে। এই শহরের আইটি খাত, সাংস্কৃতিক সম্পদ এবং সাশ্রয়ী ভাড়া এটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। অন্যদিকে, পুনে শিক্ষা এবং শিল্পের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে, যা এর বসবাসযোগ্যতার স্কোর বাড়িয়েছে। এই শহরগুলোর সফলতার মূল কারণ হলো তাদের অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য এবং ভিত্তিস্থাপনার উন্নতি।
কলকাতার তুলনায় এই শহরগুলোর উন্নয়নের পেছনে রয়েছে সরকারি উদ্যোগ এবং ব্যক্তিগত বিনিয়োগ। উদাহরণস্বরূপ, বেঙ্গালুরুতে আইটি পার্ক এবং স্টার্টআপ কেন্দ্রগুলো শহরের অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়িয়েছে। অন্যদিকে, কলকাতায় এ ধরনের উন্নয়ন কম দেখা যায়, যা এর তালিকা থেকে বাদ পড়ার একটি কারণ হতে পারে।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া: বাঙালির মনোভাব
সামাজিক মাধ্যমে এই তালিকার প্রকাশের পর থেকে বাঙালির মধ্যে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কিছু ব্যক্তি মনে করেন যে কলকাতা সংস্কৃতি, খাবার এবং ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে অন্য শহরদের তুলনায় এগিয়ে আছে এবং তালিকায় এর অনুপস্থিতি অবিশ্বাস্য। অন্যদিকে, কিছু মতামত আছে যে শহরের ভিত্তিস্থাপনা এবং পরিবহন ব্যবস্থার অবনতি এই ফলাফলের কারণ। একজন ব্যবহারকারী বলেছেন, “কলকাতা ১-৫ স্থানে থাকা উচিত ছিল, কিন্তু এই তালিকা ভুল।”
ভবিষ্যৎ উন্নয়নের সম্ভাবনা
কলকাতা এবং অন্যান্য বাংলা শহরের জন্য ভবিষ্যৎ উন্নয়নের কিছু সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ভিত্তিস্থাপনা উন্নয়ন, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি এই শহরগুলোর জীবনযাপনের মান বাড়াতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মেট্রো রেল প্রকল্প এবং স্মার্ট সিটি উদ্যোগ কলকাতাকে আধুনিক শহরে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করছে। তবে এই উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে স্থানীয় প্রশাসন এবং নাগরিকদের সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি।
কলকাতা বা অন্য কোনও বাংলা শহরের তালিকায় অনুপস্থিতি একটি চিন্তার বিষয় হলেও, এটি একটি সুযোগ হিসেবেও দেখা যেতে পারে। শহরের অবকাঠামো এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতি আনলে ভবিষ্যতে কলকাতা আবার একবার ভারতের শীর্ষ বসবাসযোগ্য শহর হিসেবে উঠে আসতে পারে। বাঙালি সমাজের এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন, যাতে আমাদের শহরগুলো আবার গর্বের কারণ হয়ে উঠে।