নিরাপত্তা রক্ষী বাহিনীর চাপে আত্মসমর্পণ মাওবাদী সুনীতার

ঝাড়খণ্ডের বোকারো জেলায় সোমবার নিষিদ্ধ সিপিআই (maoist) সংগঠনের একজন মহিলা সদস্যা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন, বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ২২ বছর বয়সী সুনীতা মুর্মু, যিনি লীলমুনি…

maoist surrender in bokaro

ঝাড়খণ্ডের বোকারো জেলায় সোমবার নিষিদ্ধ সিপিআই (maoist) সংগঠনের একজন মহিলা সদস্যা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন, বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ২২ বছর বয়সী সুনীতা মুর্মু, যিনি লীলমুনি মুর্মু নামেও পরিচিত, গত ২১ এপ্রিল বোকারোর লুগু পাহাড়ে মাওবাদীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষের সময় পালিয়ে গিয়েছিলেন ।

   

ওই সংঘর্ষে আটজন নকশাল নিহত হয়েছিলেন, যার মধ্যে সিপিআই (maoist) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিবেক ওরফে প্রয়াগ মাঝি, যার মাথার উপর ১ কোটি টাকার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়ে ছিল, অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

সুনীতা মুর্মু (maoist)

সুনীতা মুর্মু বোকারোর পুলিশ সুপার মনোজ স্বর্গিয়ারি, সিআরপিএফ কমান্ডান্ট এবং অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে আত্মসমর্পণ করেন। তিনি জানান, তিনি বাড়ির লোকেদের ডাকে সংগঠনে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে বুঝতে পারেন যে তিনি ভুল পথে রয়েছেন। এক্স-এ পোস্ট অনুযায়ী, সুনীতা গত এক সপ্তাহ ধরে জঙ্গলে ঘুরছিলেন , ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায়। শেষ পর্যন্ত তিনি বোকারো এসপির বাড়িতে পৌঁছে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন।

ঘটনার পটভূমি

২১ এপ্রিল বোকারোর লালপানিয়া এলাকার লুগু পাহাড়ের জঙ্গলে সিপিআই (maoist) দলের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর তীব্র সংঘর্ষ হয়। ‘অপারেশন দকাবেদা’ নামে এই অভিযানে ঝাড়খণ্ড পুলিশ, সিআরপিএফ-এর কোবরা ২০৯ ব্যাটালিয়ন এবং ঝাড়খণ্ড জাগুয়ার অংশ নেয়।

এই সংঘর্ষে বিবেক ছাড়াও আরও দুই জ্যেষ্ঠ নেতা, অরবিন্দ যাদব (২৫ লক্ষ টাকার পুরস্কার) এবং সাহেবরাম মাঝি ওরফে রাহুল মাঝি (১০ লক্ষ টাকার পুরস্কার) নিহত হন। নিরাপত্তা বাহিনী চারটি ইনসাস রাইফেল, একটি এসএলআর, একটি রিভলবার, আটটি দেশীয় অস্ত্র এবং অন্যান্য কৌশলগত সরঞ্জাম উদ্ধার করে।

সুনীতা মুর্মু এই সংঘর্ষের সময় পালিয়ে যান এবং জঙ্গলে লুকিয়ে থাকেন। তিনি জানান, তিনি লুগু পাহাড়ের মতো আর কোনো সংঘর্ষে নিহত হতে চান না। তাঁর এই আত্মসমর্পণ সিপিআই (maoist) সংগঠনের উপর নিরাপত্তা বাহিনীর ক্রমবর্ধমান চাপের প্রতিফলন বলে মনে করা হচ্ছে।

নিরাপত্তা বাহিনীর সাফল্য

ঝাড়খণ্ডে মাওবাদীদের (maoist) বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান গত কয়েক বছরে তীব্রতর হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে মাওবাদীদের সম্পূর্ণ নির্মূল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ২০২৫ সালে এ পর্যন্ত ঝাড়খণ্ডে ১৩ জন মাওবাদী নিহত হয়েছেন, এবং ২৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। লুগু, ঝুমরা এবং পরশনাথ পাহাড়ের মতো মাওবাদীদের দীর্ঘদিনের ঘাঁটিতে নিরাপত্তা বাহিনীর এই সাফল্য তাদের প্রভাব কমিয়ে দিয়েছে।

ঝাড়খণ্ড পুলিশের ডিজিপি এক বিবৃতিতে বাকি মাওবাদীদের (maoist) অস্ত্র সমর্পণ করে মূলধারায় ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “পুলিশের কাছে প্রত্যেক মাওবাদীর লুকানোর জায়গা , খাওয়ার জায়গা এবং যাদের সঙ্গে তারা দেখা করে, সেই সমস্ত তথ্য রয়েছে। যারা আত্মসমর্পণ করবে, তাদের পুরস্কারের টাকা এবং আইনি সহায়তা দেওয়া হবে।”

ভারতের ‘নাগ’ অস্ত্রে ভয় পেয়ে চিনের দিকে হাত বাড়াল পাক

সুনীতা মুর্মুর আত্মসমর্পণের তাৎপর্য

সুনীতার আত্মসমর্পণ মাওবাদীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান হতাশা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর চাপের ইঙ্গিত দেয়। এক্স-এ পোস্টে দেখা গেছে, অনেকে এই ঘটনাকে নিরাপত্তা বাহিনীর সাফল্য হিসেবে উদযাপন করছেন। একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “সুনীতা মুর্মুর আত্মসমর্পণ ঝাড়খণ্ড পুলিশের জন্য বড় জয়। মাওবাদীদের দিন শেষ হচ্ছে।” তবে, কেউ কেউ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, আত্মসমর্পণকারীদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে তারা পুনরায় সংগঠনে ফিরে না যায়।

সুনীতার আত্মসমর্পণের পর তিনি পুলিশের কাছে তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “আমি বাড়ির লোকেদের কথায় সংগঠনে যোগ দিয়েছিলাম। প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি, কিন্তু পরে বুঝলাম আমি ভুল পথে আছি।” তিনি জঙ্গলে এক সপ্তাহ ধরে লুকিয়ে থাকার সময় ক্ষুধা ও ভয়ের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন।

ঝাড়খণ্ডে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযান

ঝাড়খণ্ডে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। ২০২২-২৩ সালে ৭৪৫ জন মাওবাদীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, ২০ জন নিহত হয়েছেন এবং ৩৮ জন আত্মসমর্পণ করেছেন। এছাড়া, পরশনাথ এবং লুগু-ঝুমরা পাহাড়ে নতুন ২৬টি নিরাপত্তা শিবির স্থাপন করা হয়েছে, যা এই অঞ্চলে মাওবাদীদের প্রভাব কমিয়েছে।

জানুয়ারি ২০২৫-এ বোকারোর উপরঘাট জঙ্গলে দুই মাওবাদী, যার মধ্যে একজন মহিলা, নিহত হয়েছিলেন। এছাড়া, জানুয়ারিতে গিরিডি পুলিশ তালো মারান্ডি ওরফে সুনিল মারান্ডি নামে একজন মাওবাদীকে গ্রেপ্তার করে। এনআইএও বোকারোতে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে তদন্ত তীব্র করেছে, এবং ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে চাত্রো-চট্টি এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজনদের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ডিজিটাল ডিভাইস এবং নথি জব্দ করেছে।

রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট

সুনীতা মুর্মুর আত্মসমর্পণ ঝাড়খণ্ডে মাওবাদীদের ক্রমহ্রাসমান প্রভাবের প্রতিফলন। তবে, এই অঞ্চলে দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং শিক্ষার অভাবের মতো সামাজিক সমস্যাগুলি মাওবাদীদের নিয়োগের জন্য এখনও উর্বর ভূমি সরবরাহ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিরাপত্তা অভিযানের পাশাপাশি এই অঞ্চলে উন্নয়নমূলক প্রকল্প এবং পুনর্বাসন কর্মসূচি জোরদার করা প্রয়োজন।

ঝাড়খণ্ড সরকারের নতুন আত্মসমর্পণ নীতি মাওবাদীদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই নীতির অধীনে আত্মসমর্পণকারীদের আর্থিক সহায়তা, চাকরির সুযোগ এবং আইনি সুরক্ষা দেওয়া হয়। সুনীতার আত্মসমর্পণ এই নীতির সাফল্যের একটি উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

সুনীতা মুর্মুর আত্মসমর্পণ ঝাড়খণ্ডে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর ক্রমাগত সাফল্যের সাক্ষ্য বহন করে। তবে, এই অঞ্চলে মাওবাদী সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধানের জন্য নিরাপত্তা অভিযানের সঙ্গে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমন্বয় প্রয়োজন। সুনীতার মতো আরও মাওবাদী যদি মূলধারায় ফিরে আসেন, তবে ঝাড়খণ্ডে মাওবাদী প্রভাব শীঘ্রই উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে।