ব্যর্থ ‘বন্দে-ভারতের’ বলি কাঞ্চনজঙ্ঘা! রেলের তুঘলকি মানসিকতাতেই আবার মৃত্যুমিছিল?

যেন বলা যেতে পারে প্রদীপের নিচেই অন্ধকার। যে দেশে বুলেট ট্রেন চালানোর স্বপ্ন দেখানো হয়, ঘটা করে বন্দে ভারতের উদ্বোধন করা হয়, গতির সাথে পাল্লা…

Kanchanjangha express accident is a result of mismanagement of Indian railway

যেন বলা যেতে পারে প্রদীপের নিচেই অন্ধকার। যে দেশে বুলেট ট্রেন চালানোর স্বপ্ন দেখানো হয়, ঘটা করে বন্দে ভারতের উদ্বোধন করা হয়, গতির সাথে পাল্লা দিয়ে যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ফলাও করে প্রচার করা হয়, সেই দেশে বারংবার এই একই ঘটনা। অ্যান্টি-কলিশন ডিভাইস থেকে শুরু করে আন্টি-টেলিস্কোপিক বডি, আধুনিকীকরণের একাধিক কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেই অশ্বডিম্ব প্রসবই হয়েছে।

এক দশক আগের জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসই হোক বা আজকের কাঞ্চনজঙ্ঘা, সময় পাল্টালেও দুর্ঘটনার ধরণ বা কারণ, কোনোটাই কিন্তু পাল্টালো না। সেই মালগাড়ির সাথেই মুখোমুখি সংঘর্ষ, একই ধরনের দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া বগির ছবি, সেই যাত্রীদের হাহাকার, দমচাপা আর্তনাদের করুণ চিত্র আবারও একই রকম ভাবেই ফিরে এল। কেন্দ্রীয় সরকারের রেল মন্ত্রকের তরফ থেকে বারংবার অ্যান্টি-কলিশন ডিভাইস থেকে শুরু করে অ্যান্টি-টেলিস্কোপিক বডির কথা বারংবার ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কি তার আদৌ কোন প্রতিফলন ঘটেছে?

   

প্রথমেই আসা যাক অ্যান্টি-কলিশন ডিভাইসের বিষয়ে। সাধারণত একই ট্র্যাকে মুখোমুখি দুটি ট্রেন যদি চলে আসে তাহলে সে ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা এড়োনোর জন্য এই ডিভাইসের ব্যবহার। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘কবচ’। উত্তরবঙ্গের মতো এলাকা যেখানে কুয়াশার প্রকোপ বেশী দেখা যায়, সেখানে এই ডিভাইস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্যই ব্যবহার করা দরকার বলে মত বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু অতীতে বিভিন্ন দুর্ঘটনার সময় সেই অ্যান্টি-কলিশন ডিভাইস কি কাজ করেছিল ঠিকঠাক মত? প্রশ্ন উঠেছে বারংবার। অপরদিকে সেই ডিভাইসের অস্তিত্ব যে ছিল না এই ট্র্যাকে, তা স্বীকার করে নিয়েছে রেলমন্ত্রক। আবার এর সাথে জড়িয়ে আছে রাজনীতির অঙ্কও। প্রাক্তন রেলমন্ত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি তিনি রেলমন্ত্রী থাকাকালীন সমস্ত ট্র্যাকে এই ডিভাইস লাগানোর কথা ঘোষণা করে দিয়ে গিয়েছিলেন। এদিকে আবার রেলমন্ত্রক সূত্রে পাওয়া রিপোর্টে গোটা দেশে মাত্র ৪০ শতাংশ বা তার কাছাকাছি কিছু ট্র্যাকেই এই ডিভাইসের অস্তিত্ব রয়েছে।

এবার আসা যাক অ্যান্টি-টেলিস্কোপিক বগি নিয়ে। কোনো দুর্ঘটনা যদি ঘটেও যায়, সেক্ষেত্রে যাদের ট্রেনের বগি গুলি একটি আরেকটির মধ্যে দুমড়ে-মুচড়ে ঢুকে না যায়, সেই ক্ষেত্রে এই অ্যান্টি-টেলিস্কোপিক বগি খুবই কার্যকরী। প্রবল গতির অভিঘাতে এই বগিগুলি একটি আরেকটির মধ্যে না ঢুকে একটি আরেকটির উপরে উঠে যায়। কিন্তু আজকের দুর্ঘটনা যার চিত্র এখন অব্দি সামনে এসেছে , অনেকেই বলছেন যে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের বগি গুলি অ্যান্টি টেলিস্কোপিক অন্তত নয়। আবার রেল সূত্রের খবর, রাজধানী এক্সপ্রেস থেকে শুরু করে বেশ কিছু হাই প্রোফাইল ট্রেনে অ্যান্টি টেলিস্কোপিক বডির ব্যবহার বরাবরই হয়ে আসছে। কিন্তু তাহলে বাকি ট্রেনগুলোর কি দুর্ঘটনা হবার কোন সম্ভাবনা নেই? নাকি বাকি ট্রেনের যাত্রীরা রেলের চোখে যাত্রীই নয়? আজকের এই দুর্ঘটনা সেই প্রশ্নটাকে আরও একবার বড় করে সামনে নিয়ে এল।

অনেক বিশেষজ্ঞের মতে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের ‘বন্দে ভারত’এর জন্য এত খরচ করছে রেলমন্ত্রক, যে অন্যান্য ট্রেন গুলির নিরাপত্তার বিষয়টি সেখানে কিছুটা হলেও উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। কিন্তু গতির স্বপ্ন ফেরি করা বন্দে ভারত আদতেও কি সফল? ১৫০ -১৬০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায় যে ট্রেনের চলার কথা, কার্যক্ষেত্রে ঘণ্টায় ৭০-৮০ কিংবা ১০০ কি.মি. এরও কম গতিতে ছুটছে এই ট্রেন। অনেক ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে যে ট্র্যাক দরকার এই উচ্চতর গতির জন্য, সেরকম ট্রাক বা সেরকম পরিস্থিতি আমাদের দেশে এই মুহূর্তে নেই। অর্থাৎ কার্যক্ষেত্রে ফলাও করে গতির প্রচার করা বন্দে ভারতও অনেকটাই ব্যর্থ।

রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। রেলমন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী, সবাই ছুটে যাচ্ছেন ঘটনাস্থলে। প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির শোকজ্ঞাপনের সাথে সাথেই আহত, মৃত সবার জন্য ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করা হয়ে গিয়েছে। তারপর আবারও বন্দে ভারত, বুলেট ট্রেনের স্বপ্ন ফেরি হবে। কিন্তু রেলের দুর্ঘটনার সেই চেনা ছবিটা কবে পরিবর্তন হবে? সেটা বোধ হয় স্বয়ং ঈশ্বরও জানেন না। প্রকৃতির রোষের মুখে এমনিতেই উত্তরবঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থা যথেষ্ট বিপন্ন, তার উপরে এখন রেল পরিষেবা ও আগামী কিছুদিন যে ব্যাহত হতে চলেছে তা তো বলাই যায়। এই পরিস্থিতিতে অসহায় মানুষজন সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোন রাস্তা দেখতে পাচ্ছেন না। রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে রেখে আপাতত তাই সবারই একটাই প্রার্থনা, যত তাড়াতাড়ি হোক পরিস্থিতি যেন স্বাভাবিক হয়।