ভারতের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য বিচারপতির

justice-vikram-nath-india-judicial-crisis

নয়াদিল্লি: ভারতের বিচার ব্যাবস্থার মুখোশ খুলে দিয়ে চঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করলেন বিচারপতি বিক্রম নাথ। তিনি বলেছেন ভারতের জেল গুলিতে যারা বন্দি হিসেবে রয়েছেন, তাদের ৭০ শতাংশ এখনও কোনও আদালতে দোষী সাব্যস্ত হননি। এই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বিক্রম নাথ বলেছেন, “এটা শুধু পরিসংখ্যান নয়, এটা আমাদের বিচার ব্যবস্থার গভীর সংকটের প্রতিফলন।”

Advertisements

শুক্রবার একটি জাতীয় আইনি সাহায্য সম্মেলনে তিনি জানান, দেশের মোট কারাবন্দির প্রায় ৪.৩৪ লক্ষের মধ্যে ৩.০৮ লক্ষ আন্ডারট্রায়াল যাদের মামলা এখনও চলছে, কিন্তু তারা বছরের পর বছর জেলের অন্ধকারে আটকে। বিচারপতি নাথের এই বক্তব্য শুধু আইনজীবী মহল নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তিনি জরুরি ভিত্তিতে আইনি সাহায্য ব্যবস্থার সংস্কার এবং আন্ডারট্রায়ালদের মুক্তির জন্য বিশেষ ড্রাইভের আহ্বান জানিয়েছেন।

   

প্রথম পর্যায়ের নির্বাচনের পর চাঞ্চল্যকর দাবিতে চমক NDA -এর

প্রশ্ন উঠছে ভারতের বিচার ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার কি এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন?ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)-র ২০২৩-এর রিপোর্ট অনুসারে, ২০২২ সালের শেষে দেশে মোট ৫.৭৩ লক্ষ কারাবন্দি ছিল, যার ৭৫.৮ শতাংশ আন্ডারট্রায়াল। ২০২৪-এর হিসাবে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। বিচারপতি নাথ বলেন, “একজন মানুষ যদি দোষী না হয়েও ৫-৭ বছর জেলে থাকে, তাহলে সে তার জীবনের সেরা সময় হারিয়ে ফেলে।

এটা সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদের জীবন ও স্বাধীনতার অধিকার সরাসরি লঙ্ঘন।” তিনি উল্লেখ করেন, তিহার জেল, আরথার রোড জেল, যেরাওয়াদা এই বড় কারাগারগুলোতে আন্ডারট্রায়ালদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। অনেকের মামলা এত দীর্ঘস্থায়ী যে, তারা যদি দোষী সাব্যস্ত হতেন, তাহলে ইতিমধ্যে শাস্তি ভোগ করে মুক্তি পেয়ে যেতেন।এই সংকটের মূলে রয়েছে একাধিক কারণ।

প্রথমত, আইনি সাহায্যের অভাব। জাতীয় আইনি সেবা কর্তৃপক্ষ (নালসা)-র তথ্য বলছে, দেশে মাত্র ৬৫,০০০ প্যানেল আইনজীবী রয়েছেন, যারা ১.৪ বিলিয়ন জনসংখ্যার জন্য যথেষ্ট নয়। গ্রামীণ এলাকায় আইনি সাহায্য প্রায় অস্তিত্বহীন।

Advertisements

দ্বিতীয়ত, বিচারকের অভাব। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ডি.ওয়াই. চন্দ্রচূড় গত মাসে জানিয়েছেন, নিম্ন আদালতে ৪০ লক্ষের বেশি মামলা পেন্ডিং, কারণ বিচারকের পদ ২৫ শতাংশ খালি। তৃতীয়ত, পুলিশি তদন্তের দীর্ঘসূত্রিতা। অনেক মামলায় চার্জশিট দাখিলে বছর লেগে যায়।

বিচারপতি নাথ বলেন, “আমরা যদি ১৯৮৭-এর মালিমাথ কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতাম—যেমন ১৮০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করা—তাহলে এই পরিস্থিতি হত না।”এই পরিসংখ্যানের পেছনে মানুষের জীবনের গল্প রয়েছে। পটনার বাসিন্দা রাকেশ কুমার, একজন দিনমজুর, ২০১৯ সালে একটি চুরির মামলায় গ্রেফতার হন। পাঁচ বছর ধরে তিনি পটনা সেন্ট্রাল জেলে। তার স্ত্রী মীনা দেবী বলেন, “আমার স্বামীকে কোনও আইনজীবী দেওয়া হয়নি।

আমরা গরিব, কীভাবে লড়ব? বাচ্চারা স্কুল ছেড়ে দিয়েছে।” একইভাবে, মুম্বাইয়ের আরথার রোড জেলে বন্দি সুনীল মাহাতো, একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার, ২০২১ সাল থেকে একটি ছোট মারামারির মামলায় আটক। তিনি বলেন, “আমার জীবন শেষ। যদি দোষী হতাম, তাহলে অন্তত শাস্তি ভোগ করে বেরোতাম।” এই গল্পগুলো শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটা সমাজের একটা বড় অংশের বিশেষ করে দরিদ্র, দলিত, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুর্দশার প্রতিফলন।বিচারপতি নাথের প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো বাস্তবসম্মত।

প্রথমত, প্রতিটি জেলায় ‘লিগ্যাল এইড ক্লিনিক’ স্থাপন, যেখানে ২৪ ঘণ্টা আইনজীবী উপলব্ধ থাকবেন। দ্বিতীয়ত, আন্ডারট্রায়াল রিভিউ কমিটিগুলোকে (যা ২০১৪-এর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গঠিত) আরও সক্রিয় করা। এই কমিটিগুলো প্রতি তিন মাসে একবার বৈঠক করে, যাদের মামলা এক বছরের বেশি চলছে এবং জামিনযোগ্য অপরাধ, তাদের মুক্তির সুপারিশ করতে পারে।

তৃতীয়ত, ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে দ্রুত শুনানি। চতুর্থত, পুলিশকে তদন্তের জন্য কঠোর সময়সীমা বেঁধে দেওয়া। তিনি বলেন, “আমরা যদি ১৯৭৩-এর ক্রিমিনাল প্রসিডিয়ার কোডের ৪৩৬এ ধারা কঠোরভাবে প্রয়োগ করি যেখানে বলা আছে, জামিনযোগ্য অপরাধে জামিন অধিকার তাহলে ৫০ শতাংশ আন্ডারট্রায়াল মুক্তি পাবেন।”