ভারতের মহাকাশ থেকে সাগরজয়: নৌবাহিনীর কৌশলে বিপ্লব আনছে ইসরোর CMS-03

ISRO CMS-03 LVM3 Launch

দেশের মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনা করল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ISRO)। রবিবার সন্ধ্যায় শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে সফলভাবে উৎক্ষেপিত হল CMS-03, ভারতের তৈরি সবচেয়ে ভারী যোগাযোগ উপগ্রহ। প্রায় ৪,৪১০ কিলোগ্রাম ওজনের এই স্যাটেলাইটকে মহাকাশে বহন করেছে আইএসরোর শক্তিশালী বাহুবলী রকেট, LVM3-M5। উৎক্ষেপণের ২৪ ঘণ্টা আগে শুরু হয়েছিল কাউন্টডাউন, রবিবার সন্ধ্যায় নিখুঁতভাবে শেষ হয় অভিযান।

Advertisements

ভারতের নিজস্ব রকেটেই প্রথম ৪ টনের বেশি ওজনের উপগ্রহ উৎক্ষেপণ

এই প্রথমবার কোনও ভারতীয় রকেট চার টনেরও বেশি ওজনের যোগাযোগ স্যাটেলাইট মহাকাশে পৌঁছে দিল। এর আগে GSAT-11, GSAT-24 বা GSAT-20-এর মতো ভারী উপগ্রহগুলিকে উৎক্ষেপণের জন্য নির্ভর করতে হয়েছিল বিদেশি সংস্থা যেমন Arianespace বা SpaceX-এর উপর। কিন্তু CMS-03 সফলভাবে কক্ষপথে পৌঁছে যাওয়ায় প্রমাণিত হল—ভারত এখন সম্পূর্ণভাবে ‘আত্মনির্ভর’ ভারী স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে।

   

ISRO চেয়ারম্যান ভি. নারায়ণন বলেন, “এই সাফল্য আত্মনির্ভর ভারতের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। দেশীয় প্রযুক্তিতেই এখন আমরা ভারী যোগাযোগ উপগ্রহ মহাকাশে পাঠাতে সক্ষম।”

কী এই CMS-03? ISRO CMS-03 LVM3 Launch

CMS-03 (পূর্বনাম GSAT-7R) হল একটি মাল্টি-ব্যান্ড কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট, যার কার্যকাল অন্তত ১৫ বছর। এটি C, Ku এবং Ka ব্যান্ডে কাজ করবে—যার ফলে দেশের যোগাযোগ, টেলিকম ও ব্রডব্যান্ড পরিষেবায় বিপুল গতি আসবে। এর মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত এলাকাতেও উচ্চগতির ইন্টারনেট, টেলি-শিক্ষা, টেলি-মেডিসিন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার পরিষেবা আরও উন্নত হবে।

একই সঙ্গে এই উপগ্রহ ভারতের নৌবাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব আনবে। পুরনো GSAT-7 ‘রুকমিনি’-এর জায়গায় এই নতুন উপগ্রহটি যুক্ত হবে, যা নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন, বিমান ও কমান্ড সেন্টারের মধ্যে রিয়েল-টাইম সিকিওর কানেকশন নিশ্চিত করবে। এর ফলে ভারতীয় নৌবাহিনীর মেরিটাইম ডোমেইন অ্যাওয়ারনেস আরও শক্তিশালী হবে, এবং ভারতীয় মহাসাগরে কার্যত সবসময় সংযোগ বজায় থাকবে।

বাহুবলী রকেটের আরেক কৃতিত্ব

CMS-03-কে কক্ষপথে তুলেছে ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট LVM3 (Launch Vehicle Mark-3)—যাকে তার বিশাল ক্ষমতার জন্য ‘বাহুবলী রকেট’ বলা হয়।
৪৩.৫ মিটার উচ্চতা ও প্রায় ৬৪০ টন ওজনের এই রকেটটি একাধিক ধাপে কাজ করে—দুটি S200 সলিড বুস্টার, L110 লিকুইড কোর স্টেজ এবং ক্রায়োজেনিক C32 আপার স্টেজের মাধ্যমে।
এই মিশনে ব্যবহৃত আপগ্রেডেড ক্রায়োজেনিক স্টেজটি আগের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ বেশি ভার বহনের সক্ষমতা দিয়েছে, যা ভবিষ্যতের ভারী মিশনগুলির জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

Advertisements

এই উৎক্ষেপণের সঙ্গে LVM3 রকেটের অষ্টম সফল মিশন সম্পন্ন হল একটিও ব্যর্থতা ছাড়াই।

স্বনির্ভর ভারতের আকাশে নতুন আলো

CMS-03-এর সফল উৎক্ষেপণের মাধ্যমে ভারত এখন নিজের মাটিতে ভারী যোগাযোগ উপগ্রহ পাঠাতে সক্ষম দেশগুলির তালিকায় যোগ দিল। এতে বিদেশি লঞ্চিং সার্ভিসের উপর নির্ভরতা কমবে, উল্লেখযোগ্যভাবে সাশ্রয় হবে খরচ, এবং দেশের কৌশলগত স্যাটেলাইট প্রোগ্রামে স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে।

ISRO চেয়ারম্যান বলেন, “এই সাফল্য শুধু এক মিশনের জয় নয়, এটি ভারতের আত্মবিশ্বাস ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার প্রতীক।”

সামনে কী?

আগামী মার্চের মধ্যে আইএসরোর সাতটি উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা রয়েছে, এর মধ্যে ডিসেম্বর মাসে আরেকটি LVM3 মিশন এবং গগনযান প্রকল্পের প্রথম মানববিহীন উড্ডয়ন অন্তর্ভুক্ত। সেই মিশনে ‘ব্যোমমিত্রা’ নামের রোবট-অ্যাস্ট্রোনট থাকবে পরীক্ষামূলকভাবে।

চন্দ্রযান-৩-এর সাফল্যের পর CMS-03 প্রমাণ করল, একই বাহুবলী রকেট এখন ভারতের বৈজ্ঞানিক, প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্যিক, সবক্ষেত্রের যোগাযোগ ও মহাকাশ প্রয়োজনে একসঙ্গে নেতৃত্ব দিচ্ছে।