জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে ২৬ জন পর্যটকের প্রাণ কেড়ে নেওয়া ভয়াবহ জঙ্গি হামলার (Pahalgam Attack) পর ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সাতটি কঠোর পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে। হামলার সঙ্গে সীমান্তবর্তী সন্ত্রাসবাদের যোগসূত্রের অভিযোগ তুলে বুধবার পাঁচটি পদক্ষেপ ঘোষণার পর বৃহস্পতিবার আরও দুটি পদক্ষেপ যুক্ত করা হয়। এই পদক্ষেপগুলি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
ভারতের সাতটি পদক্ষেপ
১. সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত: ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত সিন্ধু জল চুক্তি তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। সরকার জানিয়েছে, যতক্ষণ না পাকিস্তান সীমান্তবর্তী সন্ত্রাসবাদের সমর্থন পুরোপুরি বন্ধ না করবে, ততক্ষণ এই চুক্তি স্থগিত থাকবে। এই চুক্তি পাকিস্তানের কৃষি এবং পানীয় জলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং এর স্থগিতকরণ দেশটির অর্থনীতি ও জনজীবনে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
২. অটারি সীমান্ত বন্ধ: বুধবার থেকে পাঞ্জাবের অটারি ইন্টিগ্রেটেড চেক পোস্ট বন্ধ করা হয়েছে। বৈধ অনুমোদন নিয়ে পারাপারকারীদের ১ মে, ২০২৫-এর মধ্যে এই পথে ফিরতে হবে। এই সিদ্ধান্ত ভারত-পাকিস্তান স্থলপথে যাতায়াত সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছে।
৩. SAARC ভিসা স্কিম বাতিল: পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য SAARC ভিসা ছাড় স্কিম (SVES) বাতিল করা হয়েছে। ইতিমধ্যে জারি করা SVES ভিসাগুলিও বাতিল করা হয়েছে, এবং ভারতে অবস্থানরত এই ভিসাধারী পাকিস্তানি নাগরিকদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়তে হবে। এই পদক্ষেপ পাকিস্তানি নাগরিকদের ভারতে প্রবেশের সমস্ত পথ বন্ধ করে দিয়েছে।
৪. পাকিস্তানি কূটনীতিকদের বহিষ্কার: নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রতিরক্ষা, নৌ এবং বিমান উপদেষ্টাদের ‘পার্সোনা নন গ্রাটা’ ঘোষণা করে এক সপ্তাহের মধ্যে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভারতও ইসলামাবাদে নিজেদের সমমানের কূটনীতিকদের প্রত্যাহার করছে।
৫. হাইকমিশনের কর্মী হ্রাস: উভয় দেশের হাইকমিশনের কর্মী সংখ্যা ৫৫ থেকে ৩০-এ নামিয়ে আনা হবে। এই হ্রাস ১ মে, ২০২৫-এর মধ্যে কার্যকর হবে। এই পদক্ষেপ দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরও সংকুচিত করবে।
৬. পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য ভিসা স্থগিত: বৃহস্পতিবার সরকার পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য সমস্ত ভিসা সেবা তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিত করেছে। ভারতে অবস্থানরত সমস্ত পাকিস্তানি নাগরিকদের ২৭ এপ্রিলের মধ্যে দেশ ছাড়তে হবে। তবে, চিকিৎসার জন্য ভিসাধারীদের ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
৭. অটারি রিট্রিট সেরেমনিতে পরিবর্তন: সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী (BSF) অটারি, হুসেনিওয়ালা এবং পাঞ্জাবের সাদকিতে রিট্রিট সেরেমনির আনুষ্ঠানিকতা হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে ভারতীয় গার্ড কমান্ডার এবং পাকিস্তানি গার্ড কমান্ডারের মধ্যে প্রতীকী হ্যান্ডশেক বন্ধ করা হয়েছে। সেরেমনির সময় সীমান্ত গেট বন্ধ থাকবে। BSF জানিয়েছে, এই পদক্ষেপ সীমান্তবর্তী শত্রুতার প্রতি ভারতের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং শান্তি ও উস্কানি একসঙ্গে চলতে পারে না।
পহেলগাঁও হামলার পটভূমি
২০ এপ্রিল, ২০২৫-এ পহেলগাঁওয়ের বাইসারান মেডোজে, যিনি ‘মিনি সুইৎজারল্যান্ড’ নামে পরিচিত, পাঁচ থেকে ছয়জন জঙ্গি পর্যটকদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এই হামলায় ২৫ জন ভারতীয় এবং একজন নেপালি নাগরিক নিহত হন। নিহতরা ভারতের ১৪টি রাজ্য থেকে এসেছিলেন। হামলার দায় স্বীকার করেছে দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (TRF), যিনি পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বার একটি শাখা। হামলার পর আন্তনাগ জেলা হাসপাতালে আহতদের ভর্তি করা হয়।
হামলার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভাপতিত্বে ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি (CCS)-এর বৈঠকে এই পদক্ষেপগুলির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সরকার হামলার মূল পরিকল্পনাকারীদের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তান হামলায় তাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং ভারতের সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতকরণকে “যুদ্ধের কাজ” হিসেবে আখ্যায়িত করে আইনি পদক্ষেপের হুমকি দিয়েছে। পাকিস্তান ভারতীয় নাগরিকদের জন্য SAARC ভিসা স্কিম বাতিল করেছে (শিখ তীর্থযাত্রীদের ব্যতীত) এবং ভারতীয় এয়ারলাইন্সের জন্য তাদের আকাশপথ বন্ধ করেছে। এছাড়া, তারা ভারতের সঙ্গে সমস্ত বাণিজ্য স্থগিত করেছে।
প্রভাব ও জনমত
পহেলগাঁও হামলা দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় হোটেল মালিক এবং দোকানদাররা মোমবাতি মিছিল করে হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। পর্যটন শিল্পের উপর এই হামলার গভীর প্রভাব পড়েছে, কারণ পহেলগাঁও ছিল পর্যটকদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য। জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ হামলার নিন্দা করে বলেছেন, এটি স্থানীয় অর্থনীতির উপর মারাত্মক আঘাত হানবে।
সামাজিক মাধ্যমে সরকারের পদক্ষেপের প্রশংসা করা হচ্ছে, তবে সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতকরণ নিয়ে কেউ কেউ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ জরুরি, তবে জল চুক্তি স্থগিতকরণ দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।”
পহেলগাঁও হামলা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন করে ফাটল ধরিয়েছে। ভারতের সাতটি পদক্ষেপ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করে, তবে এগুলি দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতকরণ এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি পাকিস্তানের অর্থনীতি ও জনজীবনে গভীর প্রভাব ফেলবে। এই পরিস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ আলোচনা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করা উভয় দেশের জন্য জরুরি।