পাঁচ বছরের দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে ভারত (India) সরকার চিনা নাগরিকদের জন্য পর্যটন ভিসা পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্ত নিল। ২০২০ সালের মে মাসে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভয়াবহ সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় জওয়ান শহিদ হওয়ার পর দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক তীব্রভাবে অবনতি ঘটে। সীমান্ত উত্তেজনার কারণে পরবর্তী কয়েক বছর ধরে কূটনৈতিক যোগাযোগ, ভ্রমণনীতি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগে এক অস্বস্তিকর দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। সেই ঘটনার প্রভাবে ভারত চিনা নাগরিকদের পর্যটক ভিসা ইস্যু করা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়।
কিন্তু ২০২৫ সালে এসে পরিস্থিতিতে সূক্ষ্ম পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দীর্ঘ আলোচনার পর ভারত সরকার নতুন করে চিনা নাগরিকদের জন্য পর্যটক ভিসা ইস্যু শুরু করেছে। এই সিদ্ধান্তকে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে, কারণ ভিসা চালু হওয়া মানে শুধুই ভ্রমণ নয় — বরং রাজনৈতিক সংকেত, কূটনৈতিক ভারসাম্য ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কের অভিমুখও এতে প্রতিফলিত হয়।
পাঁচ বছরের অচলাবস্থা ভেঙে কীভাবে নতুন সূচনা?
বিশেষজ্ঞদের মতে, গত কয়েক মাসে সীমান্তে সেনা-সংখ্যা কমানো, নিষ্ক্রিয় এলাকায় যৌথ টহল বন্ধ রাখা, উচ্চপর্যায়ের সামরিক ও কূটনৈতিক আলোচনা—সব মিলিয়ে সম্পর্ক স্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ভারত পর্যটক ভিসা পুনরায় চালু করে দেখালো যে, দুই দেশের মধ্যে কমপক্ষে ‘মানুষে মানুষে যোগাযোগ’ বা people-to-people contact নীতির প্রতি তারা এখন বেশি মনোযোগী।
চিনা পর্যটকদের জন্য ভারত বরাবরই ছিল আকর্ষণীয় গন্তব্য — বিশেষ করে বৌদ্ধ তীর্থস্থান, গোয়া-কেরালার উপকূল, লাদাখ-সিকিমের পাহাড়ি অঞ্চল, রাজস্থানের ঐতিহ্যবাহী শহর ও কলকাতা-দিল্লির সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর হাজার হাজার চিনা পর্যটক ভারতে ভ্রমণ করতেন। সেই বাজার আবার সক্রিয় হলে ভারতের পর্যটন শিল্পে বড় পরিবর্তন আসতে পারে।
নতুন নিয়মে চিনা নাগরিকদের জন্য কী সুবিধা?
পর্যটক ভিসা পুনরায় চালুর ফলে চিনা নাগরিকরা এখন অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন। বায়োমেট্রিক জমা দেওয়ার জন্য নির্ধারিত ভিসা অ্যাপ্লিকেশন সেন্টারে উপস্থিত হতে হবে। ভিসা প্রক্রিয়ায় ব্যবসা বা কর্মসংস্থানসংক্রান্ত কোনো বিশেষ সুবিধা নেই—এটি শুধুমাত্র পর্যটন উদ্দেশ্যে অনুমোদিত হবে।
তবে অনেকেই মনে করছেন, ভিসা চালুর মাধ্যমে শুধু পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে না, বরং ভবিষ্যতে শিক্ষার্থী, গবেষক, সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি ও মিডিয়া বিনিময় প্রক্রিয়াতেও সহজতা আসতে পারে—যা দীর্ঘমেয়াদে চিন-ভারত সম্পর্ককে নরম করার পথ তৈরি করবে।
কূটনৈতিক বার্তা ও রাজনৈতিক গুরুত্ব
মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, একটি দেশের পর্যটককে অন্য দেশে ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া কখনোই শুধু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়। এটি রাজনৈতিক সম্পর্কের তাপমাত্রা মাপার একটি সূচক। ভারত ও চিন উভয়েই এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ শক্তি; দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক অত্যন্ত বিস্তৃত হলেও বিশ্বাস ও নিরাপত্তা নিয়ে নানা বিতর্ক বহুদিন ধরেই রয়েছে। তাই এই সিদ্ধান্তকে বিশ্লেষকরা “cautious diplomacy” বা সতর্ক কূটনৈতিক পদক্ষেপ বলে মনে করছেন।
কেউ কেউ দাবি করছেন, ভারত এই পদক্ষেপের মাধ্যমে দেখাতে চাইছে — তারা একতরফা উত্তেজনা বাড়াতে চায় না; বরং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘উন্মুক্ততা’ ও ‘মানবিক যোগাযোগ’ নীতি বজায় রাখতে আগ্রহী। অন্যদিকে চিনও বহুদিন ধরে এই ভিসা পুনরায় চালুর প্রয়োজনীয়তার কথা বলে আসছিল। তাই এটি দ্বিপাক্ষিক আলোচনার সফল ফল।
পর্যটন ও অর্থনীতিতে সম্ভাব্য লাভ
চিনা পর্যটকদের ব্যয়ক্ষমতা আন্তর্জাতিক বাজারে সুপরিচিত। ভারতীয় পর্যটন শিল্প আবার সেই বাজারে প্রবেশ করতে পারলে হোটেল, পরিবহন, হস্তশিল্প, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও স্থানীয় ব্যবসায় সরাসরি লাভ হবে।
পশ্চিমবঙ্গের দিক থেকেও নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। কলকাতা বৌদ্ধ ঐতিহ্যের কেন্দ্র নয় ঠিকই, তবে চিনা সম্প্রদায়ের উপস্থিতি ও ঐতিহ্যবাহী চায়নাটাউন চিনা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণ বাড়াতে পারে। দার্জিলিং-কালিম্পঙ অঞ্চলের পাহাড়ি সৌন্দর্যও তাদের আগ্রহ বাড়াতে সক্ষম।
সামগ্রিক মূল্যায়ন
সীমান্তে উত্তেজনা এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি, তবে ভারত-চিন সম্পর্ক স্পষ্টতই এক নতুন পর্যায়ে পা রাখছে। পর্যটক ভিসা পুনরায় চালু হওয়া ভবিষ্যতে আরও কূটনৈতিক নরমতা, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং অর্থনৈতিক সংযোগ বাড়ানোর সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। পাঁচ বছরের বিরতি শেষে এই সিদ্ধান্ত দুই দেশের সম্পর্কের ইতিহাসে একটি ছোট কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ মোড়—যা হয়তো ভবিষ্যতে বড় পরিবর্তনের দরজা খুলে দিতে পারে।
