পাকিস্তানের বুকে কাঁপন ধরিয়ে গঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে রাফায়েল-সুখোইয়ের নাইট ল্যান্ডিং

ভারতীয় বিমান বাহিনী (আইএফ) শুক্রবার উত্তর প্রদেশের শাহজাহানপুর জেলার গঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে (Ganga Expressway airstrip) একটি যুদ্ধকালীন মহড়া পরিচালনা করেছে, যা দেশের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির ক্ষেত্রে এক…

Rafale, Sukhoi, Jaguar Conduct Night Landings on Ganga Expressway

ভারতীয় বিমান বাহিনী (আইএফ) শুক্রবার উত্তর প্রদেশের শাহজাহানপুর জেলার গঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে (Ganga Expressway airstrip) একটি যুদ্ধকালীন মহড়া পরিচালনা করেছে, যা দেশের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই মহড়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় জরুরি অবস্থা বা যুদ্ধের সময় গঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের ৩.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এয়ারস্ট্রিপকে বিকল্প রানওয়ে হিসেবে ব্যবহারের সম্ভাবনা পরীক্ষা করা। এই মহড়ায় ভারতীয় বিমান বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধবিমান এবং পরিবহন বিমান, যেমন রাফাল, সুখোই-৩০ এমকেআই, মিরাজ-২০০০, জাগুয়ার, মিগ-২৯, সি-১৩০জে সুপার হারকিউলিস, এএন-৩২ এবং এমআই-১৭ ভি৫ হেলিকপ্টার অংশ নিয়েছে। মহড়ার শুরু হয় সি-১৩০জে সুপার হারকিউলিসের সফল ল্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে, যার পরে অন্যান্য যুদ্ধবিমানগুলি তাদের শক্তি প্রদর্শন করেছে।

এই মহড়া ভারতের প্রতিরক্ষা কৌশলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে, কারণ এটি দেশের প্রথম এমন এয়ারস্ট্রিপ, যেখানে দিনের পাশাপাশি রাতেও যুদ্ধবিমানের ল্যান্ডিং সম্ভব। উন্নত আলোকসজ্জা এবং নেভিগেশন সিস্টেমের সাহায্যে এই এয়ারস্ট্রিপটি ২৪ ঘণ্টা পরিচালনার জন্য প্রস্তুত। মহড়াটি দুটি পর্যায়ে পরিচালিত হয়েছে—দিনের বেলা এবং রাতে। রাতের ল্যান্ডিং শোটি সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা ভারতের প্রতিরক্ষা অবকাঠামোর ক্ষেত্রে একটি নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছে।

   

মহড়ার তাৎপর্য
গঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের জালালাবাদ এলাকার পিরু গ্রামের কাছে অবস্থিত এই ৩.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এয়ারস্ট্রিপটি বিশেষভাবে সামরিক বিমানের ভার এবং চাপ সহ্য করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এতে প্রিসিশন অ্যাপ্রোচ লাইটিং, রিইনফোর্সড পেভমেন্ট এবং ক্যাট II ইনস্ট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম (আইএলএস) প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে, যা কম দৃশ্যমানতা বা রাতের বেলায় নিরাপদ ল্যান্ডিং নিশ্চিত করে। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে যদি বিমানঘাঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে এই ধরনের এয়ারস্ট্রিপগুলি বিমান বাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প রানওয়ে হিসেবে কাজ করতে পারে। এই মহড়ার মাধ্যমে এয়ারস্ট্রিপের কাঠামোগত শক্তি এবং পরিচালনা ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়েছে।

এই ঘটনা ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে সাম্প্রতিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। সম্প্রতি কাশ্মীরের পাহালগামে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি আরও জোরদার করা হয়েছে। এই মহড়া শুধু ভারতের সামরিক শক্তি প্রদর্শনই নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বেসামরিক এবং সামরিক অবকাঠামোর সমন্বয়ের একটি উদাহরণ।

মহড়ার বিবরণ
মহড়াটি দিনের বেলা শুরু হয়েছিল একটি এয়ার শোর মাধ্যমে, যা সকাল ৯:৪৫ থেকে ১০:৩০ পর্যন্ত চলেছিল। এর আগে সকাল ৮টায় একটি ফুল ড্রেস রিহার্সাল অনুষ্ঠিত হয়। দিনের মহড়ায় রাফাল, সুখোই, জাগুয়ার, মিরাজ-২০০০ এবং মিগ-২৯ সহ বিভিন্ন যুদ্ধবিমান টাচ-অ্যান্ড-গো অপারেশন পরিচালনা করে। এই বিমানগুলি ল্যান্ডিংয়ের পর তাৎক্ষণিকভাবে টেক-অফ করে, যা তাদের দ্রুত প্রতিক্রিয়া ক্ষমতা প্রদর্শন করে। সি-১৩০জে সুপার হারকিউলিস এবং এএন-৩২ পরিবহন বিমানগুলি বিশেষ বাহিনী মোতায়েন এবং দুর্যোগ ত্রাণ কার্যক্রমে তাদের কার্যকারিতা প্রদর্শন করে। এমআই-১৭ ভি৫ হেলিকপ্টার অনুসন্ধান, উদ্ধার এবং চিকিৎসা সহায়তার কাজে অংশ নিয়েছে।

রাতের ল্যান্ডিং শোটি এই মহড়ার অন্যতম আকর্ষণ ছিল। এটি ভারতের প্রথম এমন এয়ারস্ট্রিপ, যেখানে রাতের বেলা যুদ্ধবিমানের ল্যান্ডিং এবং টেক-অফ পরীক্ষা করা হয়েছে। এই অংশে রাফাল, সুখোই এবং জাগুয়ার বিমানগুলি তাদের নির্ভুলতা এবং কম আলোতে কাজ করার ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। এই শো দেখতে শাহজাহানপুরের স্থানীয় বাসিন্দা, স্কুলের ছাত্রছাত্রী এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

প্রস্তুতি এবং নিরাপত্তা
এই মহড়ার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। উত্তর প্রদেশ এক্সপ্রেসওয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (ইউপিইআইডিএ) এবং বিমান বাহিনীর সমন্বয়ে এয়ারস্ট্রিপের নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ধর্মেন্দ্র প্রতাপ সিং এবং পুলিশ সুপার রাজেশ দ্বিবেদী একাধিকবার স্থানটি পরিদর্শন করেছেন। নিরাপত্তার জন্য এয়ারস্ট্রিপের দুই পাশে ২৫০টিরও বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। ধুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য পানি ছিটানো এবং বিপথগামী পশুদের ব্যবস্থাপনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাতের ল্যান্ডিংয়ের জন্য উন্নত আলোক ব্যবস্থা এবং জার্মান হ্যাঙ্গার স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে ২০০-২৫০ জনের জন্য আসনের ব্যবস্থা রয়েছে।

মহড়ার সময় কাটরা-জালালাবাদ রুট সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছিল। জনসাধারণকে বিকল্প রুট ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। এই ঘটনায় অংশ নিতে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, রাজ্যের অর্থমন্ত্রী সুরেশ খান্না, সহযোগিতা বিষয়ক রাষ্ট্রমন্ত্রী জেপিএস রাঠোর, সিনিয়র বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা এবং আদানি গ্রুপের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

গঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের গুরুত্ব
৫৯৪ কিলোমিটার দীর্ঘ গঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে মিরাট থেকে প্রয়াগরাজকে সংযুক্ত করবে এবং এটি নভেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা। এই এক্সপ্রেসওয়ে উত্তর প্রদেশের চতুর্থ এমন এক্সপ্রেসওয়ে, যেখানে বিমান বাহিনীর জন্য এয়ারস্ট্রিপ রয়েছে। এর আগে আগ্রা-লখনউ, পূর্বাঞ্চল এবং বুন্দেলখণ্ড এক্সপ্রেসওয়েতে এয়ারস্ট্রিপ রয়েছে, তবে গঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে দেশের প্রথম এমন এক্সপ্রেসওয়ে যেখানে রাত্রিকালীন ল্যান্ডিংয়ের সুবিধা রয়েছে। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় প্রায় ৩৬,২৩০ কোটি টাকা।

এছাড়া, শাহজাহানপুরে এয়ারস্ট্রিপের কাছে একটি শিল্প কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে, যা হাজার হাজার যুবকের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। গঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েকে ফররুখাবাদের মাধ্যমে বুন্দেলখণ্ড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করার পরিকল্পনাও রয়েছে, যা অঞ্চলের শিল্পায়নকে ত্বরান্বিত করবে।

স্থানীয় প্রতিক্রিয়া
এই মহড়া শাহজাহানপুরের স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি করেছে। গুরুকুল বার্ড স্কুলের প্রিন্সিপাল পূজা যাদব জানিয়েছেন, তিনি তার ছাত্রদের এই ঐতিহাসিক ঘটনা দেখতে নিয়ে এসেছিলেন। দশম শ্রেণির ছাত্রী কৃতিকা বলেন, “জাগুয়ার এবং রাফালের মতো যুদ্ধবিমান প্রথমবার দেখে আমি রোমাঞ্চিত। এগুলো লাইভ দেখা একটি অনন্য অভিজ্ঞতা।” এই ঘটনা স্থানীয়দের মধ্যে জাতীয় গর্ব এবং দেশাত্মবোধ জাগিয়েছে।

গঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে ভারতীয় বিমান বাহিনীর এই মহড়া শুধু একটি সামরিক শক্তি প্রদর্শনই নয়, বরং দেশের প্রতিরক্ষা অবকাঠামোর আধুনিকীকরণ এবং বেসামরিক-সামরিক সহযোগিতার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। রাফাল, সুখোই এবং জাগুয়ারের নাইট ল্যান্ডিং ভারতের যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার প্রমাণ। এই ঘটনা ভারতের প্রতিরক্ষা কৌশলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে এবং জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।