উত্তর ভারতের হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড এবং জম্মু-কাশ্মীরে ভারী তুষারপাত (Heavy Snowfall) জনজীবনকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। রাস্তা বন্ধ, বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের সরবরাহ বিঘ্নিত এবং দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে এই তুষারপাত। আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, একটি পশ্চিমী ঝঞ্ঝার কারণে উত্তর ভারতে তুষারপাত এবং বৃষ্টির পরিমাণ বেড়েছে। এই তীব্র আবহাওয়া দিল্লি, পাঞ্জাব এবং হরিয়ানাতেও প্রভাব ফেলেছে।
হিমাচল প্রদেশ: ৫৮৩টি রাস্তা বন্ধ
হিমাচল প্রদেশে ভারী তুষারপাতের ফলে জনজীবন প্রায় থমকে গেছে। হিমাচল প্রদেশ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি জানিয়েছে, রাজ্যে ৫৮৩টি রাস্তা, যার মধ্যে পাঁচটি জাতীয় মহাসড়ক রয়েছে, বন্ধ হয়ে গেছে। তুষারপাতের কারণে ২,২৬৩টি ডিস্ট্রিবিউশন ট্রান্সফরমার (ডিটিআর) ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার ফলে অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এছাড়া, ২৭৯টি পানীয় জলের প্রকল্পও বিঘ্নিত হয়েছে। যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ এবং অনেক জায়গায় পানি এবং বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিয়েছে।
Also Read | বদ্রীনাথের কাছে ভয়াবহ তুষারপাতে ৪১ শ্রমিক নিখোঁজ, ১৬ জন উদ্ধার
কুল্লুতে শুক্রবার ভোরে একটি ভূমিধসের ঘটনায় নালা বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে জল গান্ধীনগর এবং শাস্ত্রীনগরের বাজারে ঢুকে পড়ে। কুল্লু মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট গোপাল কৃষ্ণ মহান্ত জানান, এতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কর্তৃপক্ষ নদী এবং নালার কাছাকাছি বাসিন্দাদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে। আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাস অনুযায়ী, শনিবার পর্যন্ত হিমাচলের উচ্চ এলাকায় তুষারপাত অব্যাহত থাকতে পারে।
উত্তরাখণ্ড: চামেলিতে হিমবাহে আটকে ২৪
উত্তরাখণ্ডের চামেলি জেলায় শুক্রবার একটি ভয়াবহ হিমবাহ ধসে, যার ফলে তিব্বত সীমান্তের কাছে একটি মহাসড়কে কমপক্ষে ২৪ জন তুষারের নীচে আটকে পড়েছেন। প্রাথমিকভাবে ৫৭ জন আটকে পড়েছিলেন বলে জানা গিয়েছিল, তবে সর্বশেষ খবরে ৩৩ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকাজ এখনও চলছে। ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ (আইএমডি) জানিয়েছে, শুক্রবার পর্যন্ত “ভারী থেকে অতি ভারী” তুষারপাতের পূর্বাভাস রয়েছে, যদিও শনিবার থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
চামেলির উচ্চ এলাকায় তুষারপাতের কারণে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। উদ্ধারকর্মীরা কঠিন পরিস্থিতিতে কাজ করছেন। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, শীতের মরশুমে এই অঞ্চলে হিমবাহের ঝুঁকি বেশি থাকে। আফগানিস্তান থেকে আসা এই তুষারঝড় উত্তরাখণ্ডের জনজীবনে বড় প্রভাব ফেলেছে।
জম্মু-কাশ্মীর: স্কুল ছুটি, পরীক্ষা স্থগিত
জম্মু-কাশ্মীরে একটানা বৃষ্টি এবং তুষারপাতের কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত। জম্মুতে অবিরাম বৃষ্টির কারণে বেশ কয়েকটি জেলায় স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জম্মু-কাশ্মীর সরকার কাশ্মীর উপত্যকা এবং জম্মু বিভাগের শীতকালীন অঞ্চলের স্কুলগুলোর শীতকালীন ছুটি ছয় দিন বাড়িয়েছে। সোনমার্গে বৃহস্পতিবার থেকে ২.৫ থেকে ৩ ফুট তুষার জমেছে।
জম্মু-কাশ্মীর বোর্ড অফ স্কুল এডুকেশন (জেকেবিওএসই) জেকেএবং লাদাখের হার্ড-জোন এলাকায় দশম, একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষা স্থগিত করেছে। তুষারপাতের কারণে গুলমার্গ, পহেলগাম এবং সোনমার্গের মতো পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এই তুষারপাত শীতের শুরু থেকে দীর্ঘ শুষ্ক সময়ের পর স্বস্তি এনেছে, তবে জীবনযাত্রায় বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
দিল্লি, পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায় বৃষ্টি
দিল্লি শুক্রবার হালকা বৃষ্টি পেয়েছে, যা বৃহস্পতিবার ফেব্রুয়ারির উষ্ণতম রাতের পর স্বস্তি এনেছে। আইএমডি জানিয়েছে, শনিবার ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি থাকবে। পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার বিভিন্ন এলাকায়ও বৃষ্টি হয়েছে। পাঞ্জাবে আমৃতসরে ১৭.৫ মিলিমিটার, লুধিয়ানায় ৫.৮ মিলিমিটার এবং গুরুদাসপুরে ২০.৭ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। হরিয়ানায় আম্বালায় ৬.২ মিলিমিটার, হিসারে ২.৮ মিলিমিটার এবং কর্নালে ৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
এই বৃষ্টি উত্তর ভারতের সমতলভূমিতে শীতের অনুভূতি ফিরিয়ে এনেছে। পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা এই বৃষ্টিকে স্বাগত জানিয়েছেন, কারণ এটি রবি শস্যের জন্য উপকারী। তবে, দিল্লিতে বৃষ্টির কারণে সকালে যানজট এবং কুয়াশার সমস্যা দেখা দিয়েছে।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস
আইএমডি জানিয়েছে, পশ্চিমী ঝঞ্ঝার প্রভাবে উত্তর ভারতের পার্বত্য এলাকায় শনিবার সকাল পর্যন্ত তুষারপাত ও বৃষ্টি অব্যাহত থাকবে। হিমাচলের উচ্চ এলাকায় কমলা সতর্কতা জারি রয়েছে। উত্তরাখণ্ডে শনিবার থেকে আবহাওয়ার উন্নতি হতে পারে। জম্মু-কাশ্মীরে তুষারপাতের তীব্রতা কমলেও শীতের প্রকোপ অব্যাহত থাকবে। দিল্লি, পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায় শনিবার হালকা বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রশাসনের তৎপরতা
হিমাচল প্রদেশে স্থানীয় প্রশাসন রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য যন্ত্রপাতি মোতায়েন করেছে। উত্তরাখণ্ডে চামেলির উদ্ধারকাজে ভারতীয় সেনা এবং স্টেট ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স (এসডিআরএফ) কাজ করছে। জম্মু-কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনী তুষারপাতে আটকে পড়া পর্যটকদের উদ্ধারে সহায়তা করছে। প্রশাসন জনগণকে অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ এড়াতে এবং সতর্ক থাকতে বলেছে।
জনজীবনে প্রভাব
এই তুষারপাত ও বৃষ্টি উত্তর ভারতের পার্বত্য এলাকায় জীবনকে কঠিন করে তুলেছে। হিমাচলের অনেক গ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উত্তরাখণ্ডে হিমবাহের ঘটনায় উদ্বেগ বেড়েছে। জম্মু-কাশ্মীরে স্কুল বন্ধ এবং পরীক্ষা স্থগিত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটেছে। তবে, সমতলভূমিতে বৃষ্টি কৃষকদের জন্য স্বস্তি এনেছে।
এই আবহাওয়া পরিস্থিতি উত্তর ভারতের জন্য একটি দ্বিমুখী প্রভাব ফেলেছে। একদিকে তুষারপাত পর্যটনের জন্য আকর্ষণীয় হলেও, জনজীবনে বিঘ্ন ঘটিয়েছে। শনিবার পর্যন্ত সবার নজর থাকবে আবহাওয়ার উন্নতির দিকে।