পঞ্জাবের অমৃতসরে অবস্থিত স্বর্ণ মন্দিরে (Golden Temple) বোমা হামলার হুমকি ইমেল পাওয়ার পর মন্দির কমপ্লেক্সে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত জোরদার করা হয়েছে। শিরোমণি গুরুদ্বারা প্রবন্ধক কমিটি (এসজিপিসি) এই হুমকি ইমেলটি পেয়েছে, যেখানে মন্দির চত্বরে বিস্ফোরক রাখা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। এই ঘটনায় এসজিপিসি কর্মকর্তারা এবং পঞ্জাব পুলিশ তৎক্ষণাৎ সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এই প্রতিবেদনে আমরা এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করব।
ইমেলে আরডিএক্সের উল্লেখ, তৎক্ষণাৎ পদক্ষেপ
এসজিপিসির প্রধান সচিব কুলবন্ত সিং মান্নান জানিয়েছেন যে হুমকি ইমেলে স্বর্ণ মন্দিরে আরডিএক্স বিস্ফোরক রাখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং পবিত্র এই স্থানের ক্ষতি করার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। যদিও ইমেলে নির্দিষ্ট সময়ের উল্লেখ ছিল না, তবে সোমবারকে সম্ভাব্য হামলার দিন হিসেবে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
এই হুমকির পর এসজিপিসি তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে। অমৃতসরের পুলিশ কমিশনার এবং স্থানীয় থানার এসএইচও দ্রুত মন্দিরে পৌঁছে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। এসজিপিসির প্রেসিডেন্ট হরজিন্দর সিং ধামি এই বিষয়ে অবহিত হন এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য একটি উচ্চ-পর্যায়ের পর্যালোচনা সভা আহ্বান করা হয়।
মন্দির চত্বরে কড়া নিরাপত্তা
মান্নান জানান, যদিও এই ইমেলটি ভুয়ো এবং ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে পাঠানো হতে পারে, তবুও “আমরা কোনো ঝুঁকি নিচ্ছি না।” স্বর্ণ মন্দিরের পরিক্রমা পথ (পরিধি পথ) এবং গলিয়ারা (আশপাশের গলি) সহ পুরো মন্দির কমপ্লেক্সে নিরাপত্তা টহল জোরদার করা হয়েছে। সিসিটিভি নজরদারি বাড়ানো হয়েছে, এবং সাম্প্রতিক ফুটেজ বিশদভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা হিসেবে, মান্নান জানান যে মূল চেকপয়েন্টগুলিতে নিরাপত্তা স্ক্যানার স্থাপনের কাজ চলছে এবং আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এটি সম্পন্ন হবে।
এসজিপিসি এবং পুলিশের সমন্বিত প্রচেষ্টায় মন্দিরের প্রবেশপথ, লঙ্গর হল এবং সরাইগুলিতে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। এসজিপিসির টাস্ক ফোর্স এবং পুলিশের অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। এসজিপিসির প্রেসিডেন্ট ধামি জানিয়েছেন, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো বিবৃতি দেওয়া হবে না, যাতে ধর্মীয় স্থানে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি না হয়। তিনি জনগণকে গুজবের প্রতি মনোযোগ না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
পুলিশের তদন্ত এবং এফআইআর
অমৃতসরের পুলিশ কমিশনার গুরপ্রীত সিং ভুল্লার জানিয়েছেন, এসজিপিসির অভিযোগের ভিত্তিতে একটি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে এবং পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা স্টেট সাইবার ক্রাইম সেল এবং অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে কাজ করছি এই ইমেলের উৎস খুঁজে বের করতে।” বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল, অ্যান্টি-সাবোটেজ দল এবং ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের স্বর্ণ মন্দিরের আশপাশে মোতায়েন করা হয়েছে যাতে পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
ভুল্লার আরও জানান, প্রাথমিক তদন্তে মনে হচ্ছে এই ইমেলটি দক্ষিণ ভারতের কিছু ঘটনার উল্লেখ করে দুষ্টুমির উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছে। তবে, পুলিশ এই হুমকিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে এবং দ্রুত এই মামলার সমাধানের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। সাইবার ক্রাইম সেল ইমেলের উৎস সনাক্ত করতে প্রযুক্তিগত তদন্ত চালাচ্ছে।
জনগণকে আশ্বস্ত করা: ‘আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই’
কমিশনার ভুল্লার জনগণকে আশ্বস্ত করে বলেছেন যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তিনি বলেন, “এই ইমেলটি সম্ভবত কোনো দুরভিসন্ধিমূলক ব্যক্তির দ্বারা পাঠানো হয়েছে এবং এতে স্বর্ণ মন্দিরের পাশাপাশি দক্ষিণ ভারতের কিছু ঘটনার অস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।” তিনি জনগণকে শান্ত থাকতে এবং যেকোনো সন্দেহজনক কার্যকলাপের তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশকে জানানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
পুলিশ এবং এসজিপিসি উভয়ই জনগণকে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল এবং কুকুর বাহিনী মন্দির চত্বর পরিদর্শন করছে, এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
পূর্ববর্তী ঘটনা এবং প্রেক্ষাপট
এটি প্রথমবার নয় যে স্বর্ণ মন্দির বোমা হুমকির মুখে পড়েছে। ২০২৩ সালের জুন মাসে একটি ভুয়ো বোমা হুমকি ফোন কল পাওয়ার পর পঞ্জাব পুলিশ উচ্চ সতর্কতায় ছিল। সেই ঘটনায় কোনো বিস্ফোরক পাওয়া যায়নি, এবং একজন যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এছাড়াও, ২০২৩ সালের মে মাসে স্বর্ণ মন্দিরের কাছে তিনটি কম তীব্রতার বিস্ফোরণ ঘটেছিল, যা খালিস্তানপন্থী কর্মীদের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই পূর্ববর্তী ঘটনাগুলি বর্তমান হুমকির গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
এছাড়াও, ২০২৫ সালের মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্বর্ণ মন্দিরকে ড্রোন এবং মিসাইল হামলা থেকে রক্ষা করেছিল। এই ঘটনাগুলি স্বর্ণ মন্দিরের নিরাপত্তার গুরুত্বকে আরও জোর দিয়েছে।
সম্ভাব্য প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
স্বর্ণ মন্দির, যা শিখ সম্প্রদায়ের পবিত্রতম স্থান, প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্ত এবং পর্যটকের সমাগম ঘটায়। এই ধরনের হুমকি শুধুমাত্র নিরাপত্তার উদ্বেগই বাড়ায় না, বরং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতাকেও প্রভাবিত করে। এসজিপিসি এবং পুলিশের দ্রুত পদক্ষেপ এই ঘটনায় তাদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়। তবে, এই ধরনের হুমকি বারবার ঘটলে জনগণের মধ্যে ভয় এবং অনিশ্চয়তা বাড়তে পারে।
আগামী দিনগুলিতে, তদন্তের অগ্রগতি এবং ইমেলের উৎস সনাক্তকরণ এই ঘটনার প্রকৃতি সম্পর্কে আরও তথ্য প্রকাশ করবে। এসজিপিসির পরিকল্পিত স্ক্যানার স্থাপন এবং উন্নত নজরদারি ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
স্বর্ণ মন্দিরে বোমা হুমকির ঘটনা অমৃতসর এবং পঞ্জাবের জনগণের জন্য উদ্বেগজনক হলেও, পুলিশ এবং এসজিপিসির তৎপরতা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। তদন্ত চলছে, এবং সাইবার ক্রাইম সেলের সহায়তায় এই হুমকির উৎস শীঘ্রই সনাক্ত করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। জনগণকে শান্ত থাকার এবং সতর্কতা অবলম্বন করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এই ঘটনা আমাদের ধর্মীয় স্থানগুলির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথা মনে করিয়ে দেয়।