বাঙালির করিমগঞ্জ এখন শ্রীভূমি, রবীন্দ্রনাথ লিখিত শ্রীভূমি কোনটি? তিনি কেন লিখেছিলেন?

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রে অসম (Assam) দুটি ভাগে বিভক্ত। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা উজানি অসম ও বরাক উপত্যকা তথা ভাটি অসম। উজান-ভাটির এই স্রোতে এ…

Karimganj to Shreebhumi in Honor of Rabindranath Tagore

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রে অসম (Assam) দুটি ভাগে বিভক্ত। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা উজানি অসম ও বরাক উপত্যকা তথা ভাটি অসম। উজান-ভাটির এই স্রোতে এ রাজ্যে অহম ও বাঙালিরা ভেসে চলেছেন। বরাক উপত্যকা বাঙালি প্রধান। বাংলা ভাষার অধিকার চেয়ে ১৯৬১ সালে ১১ বাঙালি শহিদ হয়েছেন এই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার শিলচরে। দেশে মাতৃভাষা আন্দোলনের তীর্থস্থল অসম। রাজ্যটির তিন বাংলাভাষী প্রধান জেলা হলো কাছাড়, হাইলাকান্দি ও শ্রীভূমি (করিমগঞ্জ)।

বুধবার (১৯ নভেম্বর) অসমের মু়খ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা ঘোষণা করেন, এদিন থেকে করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন করে শ্রীভূমি রাখা হয়েছে। তিনি লিখেছেন, “ভারতের গৌরবময় ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ও সাধারণ জনগণের ইচ্ছা এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বপ্নকে সম্মান প্রদর্শন করে রাজ্য মন্ত্রিসভা আজ করিমগঞ্জ জেলাকে শ্রীভূমি জেলা হিসেবে নামকরণ করার অনুমতি দিয়েছে।” তিনি লিখেছেন “১০০ বছরেরও বেশি আগে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসমের আধুনিক করিমগঞ্জ জেলাকে ‘শ্রীভূমি’ – মা লক্ষ্মীর ভূমি হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। আজ অসম মন্ত্রিসভা আমাদের জনগণের এই দীর্ঘ দিনের দাবি পূরণ করেছে।”

   

জেলা করিমগঞ্জের নাম বদল বিতর্ক নতুন নয়। পক্ষে বিপক্ষে দাবি পাল্টা দাবি চলেছে। ‘শ্রীভূমি’ নাম ঘোষণার পর উল্লাস যেমন চলেছে। তেমনই প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষণে উঠে আসছে, বিতর্ক ঢাকতে রবীন্দ্রনাথের নাম ও কবিতা ব্যবহার করেছে অসমের বিজেপি সরকার। অভিযোগ, দেশে অন্যত্র যেমন মুসলিম সংযোগ অঞ্চল বা প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে দিচ্ছে বিজেপি তেমনই প্রক্রিয়ায় করিমগঞ্জ বদলে হলো শ্রীভূমি।

রবীন্দ্রনাথ লিখিত শ্রীভূমি কোনটি? তিনি কেন লিখেছিলেন?
১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড হয়। মর্মাহত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি প্রতিবাদ জানিয়ে ‘স্যার’ উপাধি ত্যাগ করেন। এই ঘটনার মাস চারেক পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা থেকে শিলং এসেছিলেন। তখন শিলং আসামের (অসম) রাজধানী। আর এই বিভাগের তৎকালীন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল সিলেট (শ্রীহট্ট)। বাংলাভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠ সিলেট। রবীন্দ্রনাথ শিলং এসেছেন শুনে সিলেটের ব্রাহ্মসমাজ সাধারণ সম্পাদক গোবিন্দনারায়ণ সিংহ মজুমদার উদ্যোগ নেন কবিকে সিলেট দর্শন করানোর। তাঁর উদ্যোগে স্থানীয় আঞ্জুমানে ইসলাম, শ্রীহট্ট মহিলা সমিতি এবং বিভিন্ন সংগঠনের তরফেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। শিলং থেকে গৌহাটি (গুয়াহাটি) হয়ে পাহাড়ি রেলপথ ধরে লামডিং হয়ে সিলেটে আসেন রবীন্দ্রনাথ।

শ্রীহট্ট তথা সিলেটের প্রাকৃতিক শোভা ও বড় সংখ্যায় উচ্চশিক্ষিত বাংলাভাষীদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন-
“মমতাবিহীন কালস্রোতে
বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হোতে
নির্বাসিতা তুমি সুন্দরী শ্রীভূমি।
ভারতী আপন পুণ্যহাতে
বাঙালীর হৃদয়ের সাথে
বাণীমাল্য দিয়া
বাঁধে তব হিয়া।
সে বাঁধনে চিরদিন তরে তব কাছে
বাঙলার আশীর্বাদ গাঁথা হয়ে আছে।’’

রবীন্দ্রনাথের সিলেট ভ্রমণের স্মারক গ্রন্থ ১৯৪১ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইতে সিলেট সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তে লিখিত ‘কবি প্রণাম’ এবং  নামে স্বাক্ষরিত ছিল কবিতাটি। এই কবিতায় লেখা ‘শ্রীভূমি’ শব্দটি অসমের করিমগঞ্জ জেলার নতুন নাম হিসেবে সে রাজ্যের সরকার আনল।

গণভোটে সিলেট হয়েছিল পাকিস্তানের, করিমগঞ্জ ঢুকেছিল ভারতে:
ভারত ভাগের আগে সিলেট ছিল অসমের অন্তর্গত। ভৌগোলিক কারণে বাংলাভাষী অধ্যুষিত সিলেটের সঙ্গে সবসময় সংযোগ ছিল পূর্ব বাংলার। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হবার সময় সিলেট কোন দেশে পড়বে সেটি ছিল চরম বিতর্কিত ইস্যু। সিলেটবাসীকে গণভোটে দেশ বেছে নিতে সুযোগ দেওয়া হয়। ঐতিহাসিক সিলেট গণভোট ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ও ৭ জুলাই অনুষ্ঠিত হয়। সেই গণভোটে সিলেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দা পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেন। করিমগঞ্জ অংশটি পড়ে যায় ভারতের দিকে অসমের অংশে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হয়। সেদিন থেকে সিলেট বাংলাদেশের একটি বিভাগ। 

১৯৮৩ সালে অসম সরকার করিমগঞ্জ মহকুমাকে পূর্ণ জেলার স্বীকৃতি দেয়। ২০২৪ সালে নাম পাল্টে হলো শ্রীভূমি। রবীন্দ্রনাথের ‘শ্রীভূমি’ ছিল সিলেট।