উত্তম-সৌমিত্রর মতান্তর এবং অভিনেত্রী সঙ্ঘ ভেঙে শিল্পী সংসদ

বিশেষ প্রতিবেদন: বঙ্গ জীবনে এমন কতগুলি শব্দযুগল জড়িয়ে রয়েছে যা নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বাঙালিদের মধ্যে তর্ক-ঝগড়া চলে৷ মোহনবাগান না ইস্টবেঙ্গল, হেমন্ত না মান্না, সত্যজিৎ না…

Special report on Uttam Kumar's death day

বিশেষ প্রতিবেদন: বঙ্গ জীবনে এমন কতগুলি শব্দযুগল জড়িয়ে রয়েছে যা নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বাঙালিদের মধ্যে তর্ক-ঝগড়া চলে৷ মোহনবাগান না ইস্টবেঙ্গল, হেমন্ত না মান্না, সত্যজিৎ না ঋত্বিক, উত্তম না সৌমিত্র।

এটা ঘটনা উত্তমকুমার এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ফ্যানেরা এই দুই তারকাকে নিয়ে যতোই তর্ক-বিতর্ক করুক না কেন, আর পেশাগত দিক দিয়ে রেষারেষি যাই থাকুক না কেন ব্যক্তিগত জীবনে দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ছিল খুবই ভাল৷ তবে ষাটের দশকের শেষ দিকে উত্তম- সৌমিত্রের মধ্যকার ব্যক্তিগত সংঘাত হয়েছিল যার জন্য দুই ব্যক্তিত্বের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়। যদিও কিছুদিন পরেই তা আবার ঠিক হয়ে যায়। তবে তাদের দূরত্বের পাশাপাশি ওই সময় ভাঙন ধরেছিল অভিনেতা কলাকুশলীদের সংগঠনেও।

৬০-এর দশকের শেষ দিকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাচ্ছে না বলে ক্ষোভ দেখা গিয়েছিল সিনেমার নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত কলাকুশলীদেরও মধ্যে। যারফলে বেশ কিছু দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেয় ‘‌সিনে টেকনিশিয়ানস ওয়াকার্স ইউনিয়ন’‌।

১৯৬৮ সালে যখন এই ধর্মঘট শুরু হয় তখন ‘‌অভিনেতৃ সঙ্ঘ’ তা নৈতিক সমর্থন করে। তখন ‘অভিনেতৃ সঙ্ঘ’‌–এর সভাপতি হলেন উত্তমকুমার এবং সম্পাদক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এদিকে রাজ্যে যুক্তফ্রন্ট সরকার থাকায় কর্মচারি ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলিরও তখন বেশ জঙ্গি মনোভাব। সেই সময় আবার গঠিত হয় ‘‌পশ্চিমবঙ্গ চলচ্চিত্র সংরক্ষণ সমিতি’‌ এবং এই সংগঠনে পুরোভাগে ছিলেন উত্তমকুমারের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন প্রযোজক।

ওই সময় অভিনেতৃ সঙ্ঘের একাংশ সঙ্ঘের তহবিল থেকে দশ হাজার টাকা ধর্মঘটীদের দিতে চায়। কিন্তু তা নিয়ে মতভেদ দেখা যায় ৷ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপকুমাররা ছিলেন টাকা দেওয়ার পক্ষে কিন্তু বিকাশ রায় জহর গাঙ্গুলীরা তার বিরোধিতা করেন৷ এদিকে উত্তমকুমার প্রযোজকদের প্রতিনিধি হয়ে পড়েছেন বলে তখন অভিযোগ ওঠে। তা নিয়ে পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয় যে উত্তমকুমার সৌমিত্র এবং ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর বেশ ক্ষুব্ধ হন৷ ফলে পরিস্থিতি এমনই পর্যায়ে দাঁড়ায় যে সদস্যদের মধ্যে ভোটাভুটি করতে হয়৷ আর সেই ভোটে জিতে অভিনেত্রী সঙ্ঘের সভাপতি হন সৌমিত্র৷ এর পর যথারীতি সঙ্ঘ ধর্মঘটীদের ১০,০০০টাকা দেয়৷

অন্যদিকে উত্তমকুমার ক্ষুব্ধ হয়ে সঙ্ঘ ছেড়ে বেরিয়ে এসে তৈরি করেন শিল্পী সংসদ৷ উত্তমের সঙ্গে শিল্পী সংসদে তখন বিকাশ রায় জহর রায়েরা ৷ অন্যদিকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়েরা অভিনেত্রী সংঘে৷ আপাতদৃষ্টিতে মনে করা হয়ে থাকে বামপন্থীরা তখন ‘‌অভিনেতৃ সঙ্ঘ’‌–এ এবং কংগ্রেসী সমর্থকরা যোগ দিয়েছেন ‘‌শিল্পী সংসদ’‌–এ। তবে অতটা সরল বিভাজন তখন সেটা ছিল না কারণ বিপরীত মতাদর্শের লোক হলেও অনিল চট্টোপাধ্যায়, নির্মল ঘোষেরা কিন্তু শিল্পী সংসদে যোগ দেন ৷ মতাদর্শের পাশাপাশি বাংলা রুপালি পর্দার দুই নায়কের ব্যক্তিগত সংঘাতও সেই সময় কাজ করেছিল সংগঠনের ক্ষেত্রে বলে মনে করেন অনেকে ৷

তবে এটাও ঘটনা এর কিছু দিন বাদে বসুশ্রী সিনেমা হলে এক অনুষ্ঠানে মঞ্চে অন্যান্য শিল্পীদের সঙ্গে হাজির ছিলেন উত্তম সৌমিত্র এবং ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ সেখানে সৌমিত্র ভানুকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেও উত্তমকুমারকে হাতজোড় করে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন৷ তখন উত্তমকুমার সৌমিত্রের কাছে জানতে চান, এতদিন সৌমিত্র উত্তমকে বড় ভাইয়ের মতো ভেবে পায়ে হাত দিয়ে তাকে প্রণাম করে এসেছেন কিন্তু এখন তাদের সংগঠন আলাদা হয়ে গিয়েছে বলেই এমন আচরণ করা হল? তখন অবশ্য সৌমিত্র পায়ে হাত দিতে প্রণাম করে ক্ষমা চেয়ে নেন এবং উত্তমও তাঁকে জড়িয়ে ধরেন৷ আর দুজনের সম্পর্কের বরফ গলে আগের মতো হয়ে যায়৷