পরাজিতদের জন্য অপরাজিত

যেন পুরনো দিনের কোনো ডায়েরি। যার একের পর এক উল্টে চলা পাতা স্টিল ছবির চলমান অনুকরণ। ফ্রেম বাই ফ্রেম তোলা স্থির চিত্র, যার গতিমানতা জন্ম…

যেন পুরনো দিনের কোনো ডায়েরি। যার একের পর এক উল্টে চলা পাতা স্টিল ছবির চলমান অনুকরণ। ফ্রেম বাই ফ্রেম তোলা স্থির চিত্র, যার গতিমানতা জন্ম দেয় আস্ত একটা সিনেমার।

বাংলা সিনেমায় বিপ্লব এনেছিল সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী। গ্যাদগ্যাদে মেলোড্রামার জাল কেটে বাংলা সিনেমায় জন্ম দিয়েছিলেন নতুন এক প্রবাহ। সিনেমা হলের পর্দায় যখন ‘অপরাজিত’, তখন পাশাপাশি অন্যান্য হলে রমরমিয়ে চলছে একাধিক বাণিজ্যিক ছবি। নাচ, গান, মনোরঞ্জনে ভরপুর বাণিজ্যিক ছবি। সত্যজিৎ রায়ের সময়েও বাংলার রঙমহলে নায়ক-নায়িকা কেন্দ্রিক ছবি।

   

‘পথের পদাবলী’ তৈরি করার আগে পর্দার অপরাজিত রায়কে পেরোতে হয়েছিল বহু বাধা। যেমনটা পথের পাঁচালী তৈরি করার সময় অতিক্রম করতে হয়েছিল সত্যজিৎ রায়কে। সিনেমা পাড়ায় কয়েকজন আনকোরা বন্ধুকে শুরু করতে হয়েছিল শ্যুটিংয়ের কাজ। নাচ গান, রোমান্স ছাড়া সিনেমা তাই প্রোডিউসার মেলা ছিল দুষ্কর। নিজের জমানো সখের সিডি কালেকসন, জীবন বীমা বিক্রি করে টাকা জমা করার কথা ভেবেছিলেন রায়। গয়না বন্ধন রেখে স্বামীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন স্ত্রী।

ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই সময়ে সিনেমা দেখা ছিল অপরাধ তুল্য। ডিক্লাস হতে হতো সিনেমা প্রেমী শিক্ষিত মানুষদের। সেই অর্থে রায়কেও করা হয়েছিল শ্রেণীচ্যুত। সম্বল বলতে ছিলেন কয়েকজন বন্ধু এবং তাঁর স্ত্রী। সিনেমা প্রেমীদের নিয়ে গড়েছিলেন ফিল্ম সোসাইটি।

পথের পাঁচালী কিংবা পর্দার আড়ালে সত্যজিৎ রায়ের কর্মকাণ্ড ইতিমধ্যে বহু আলোচিত, বহু চর্চিত। অপরাজিত সিনেমায় সেই সময় বহু তথ্যের মেলবন্ধন। সিনেমায় চিত্রের কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ের নাম বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন অপরাজিত ছবির কুশলীরা। জীতু কমলকে কাস্ট করে আগেই নজর কেড়েছেন পরিচালক অনীক দত্ত। সিনেমার অন্যান্য শিল্পীরাও প্রশংসার যোগ্য।

সিনেমা শেষে হাততালি দিয়ে উঠেছেন দর্শকরা। ভালো লেগেছে বলেই তাঁরা হাততালি দিয়েছেন। ছবির একটি অংশে অপরাজিত রায়কেও তো বলতে শোনা গিয়েছে যে যারা পয়সা দিয়ে হলে এসে সিনেমা দেখবেন তাঁদের পছন্দ অপছন্দটা জরুরি। এদিক থেকে অনীক দত্ত সফল।

সিনেমায় কলাকুশলীদের অভিনয় যেমন দর্শকদের ভালো লাগার একটা কারণ, তেমনই অন্য একটা কারণ হতে পারে নিস্টালজিয়া। পথের পাঁচালী দেখেননি এমন বাঙালির সংখ্যা বোধহয় কম। কাশফুলের মধ্যে দিয়ে অপু দুর্গার ছুটে চলার আইকনিক দৃশ্য, সর্বমঙ্গলাদের করুণ অবস্থা, টাক মাথায় বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা… এসবই তো বাঙালির মজ্জায়।

তবু কিছু দৃশ্য আরও একটু নিখুঁত হলে হয়তো আরো ভালো হতো। শ্যুটিংয়ের সময়ে ঝড়ের যে দৃশ্য দেখানোর হয়েছে সেটি কারও চোখে লাগতে পারে। কারণ পিছনের দিকে গাছপালায় দুলুনি প্রায় ছিল না বললেই চলে। পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত মুখ্যমন্ত্রী বিমান রায়ের চরিত্রটি নিয়ে আলোচনা চলতে পারে।