মোদীর জয়রথ কী অপ্রতিরোধ্য?

বারবার তিনবার বিজয়ী হওয়ার জন্য একজন নেতার কতটা জনপ্রিয়, কতটা কর্মদক্ষ হওয়া প্রয়োজন নেহরু-উত্তর ভারতে কখনও সেভাবে তার পরীক্ষাই হয়নি। অনুমান করা যেতে পারে আম-ভোটারের…

Narendra Modi's Jayarath Faces Challenges Despite Surpassing Indira Gandhi's Record

বারবার তিনবার বিজয়ী হওয়ার জন্য একজন নেতার কতটা জনপ্রিয়, কতটা কর্মদক্ষ হওয়া প্রয়োজন নেহরু-উত্তর ভারতে কখনও সেভাবে তার পরীক্ষাই হয়নি। অনুমান করা যেতে পারে আম-ভোটারের একটা বড় অংশের, বিশেষ করে কোটি কোটি গরীব গুর্বের যাবতীয় আশা-ভরসার প্রতীক হয়ে উঠতে না পারলে এমন অসাধ্য সাধন অসম্ভব। প্রশ্ন হোল নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদী (Narendra Modi) তা পেরেছেন কী? পারলেও কতটা?

গত নির্বাচনে তিনি নিজেই স্লোগান দিয়েছিলেন, “মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়।” এবার এখনও পর্যন্ত তেমন কিছু শোনাই যায়নি। না প্রধানমন্ত্রীর নিজের মুখে না তাঁর অযুত ভক্তবৃন্দের কারও গলায়। তাহলে কী ধরে নেওয়া অসঙ্গত হবে যে তাঁর নিজের কার্যকালের রেকর্ডের দিকে তাকিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেই আর তেমন আত্মবিশ্বাসী হতে পারছেননা? এ কথা বড় মুখ করে বলতে পারছেননা যে আমি যা কিছু সম্ভব করব বলে পাঁচ বছর আগে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম তার সব কয়টি সম্ভব করে দেখিয়ে দিয়েছি? সেজন্যই কী বিরোধীরা সোচ্চারে একথা বলার অবকাশ পেয়ে যাচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রী যা যা করবেন বলেন তার সবটুকুই ‘জুমলা’?

   

এদেশের রাজনীতির অভিধানে ‘জুমলা’ শব্দটির সংযোজন অবশই মোদী জমানার সৌজন্যে। সত্যি কথা বলতে শব্দটির সঠিক অর্থ আমি অদ্যাবধি হৃদয়ঙ্গম করে উঠতে পারিনি। শুধু এটুকু বুঝেছি, অসম্ভব জেনেও কোনও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দেওয়া।ভোটের মঞ্চে নেতা-নেত্রীরা একটু বাড়িয়ে-চড়িয়ে কথাবার্তা বলবেন, বিরোধীপক্ষকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে গালমন্দ করবেন, এটাই দস্তুর। কিন্তু মুখ ফসকেও কেউ যদি আকাশের চাঁদ হাতে তুলে দেওয়ার মতো আজগুবি প্রতিশ্রুতি দেন, কপাল মন্দ হলে সারাজীবন সে কথা বক্তার পিছনে ধাওয়া করে বেরোবে, তখন পরিত্রাণের রাস্তা মেলেনা। যেমন আমার মনে পড়ে ১৯৮৪-র লোকসভা ভোটে হাওড়ায় কংগ্রেসের প্রার্থী মনোনীত হওয়ার পরে প্রয়াত প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি তাঁর পকেটে বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়ার চাবির গোছা আছে বলে প্রতিটি সভায় দাবি করতেন। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পরে হাওড়ার একটি বন্ধ কারখানাও খুলতে পারেননি কিন্তু চাবির খোঁটা তাঁকে মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছিল তারপরেও বহুদিন। একইভাবে ২০১৪-র ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদী বিদেশে গোপনে রক্ষিত কালাধন ফিরিয়ে এনে প্রত্যেক ভারতবাসীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা জমা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। দশ বছর পরে সেই আজগুবি প্রতিশ্রুতি মনে করিয়ে দিতে বিজেপি বিরোধীরা ভুল করছেননা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো প্রতিটি জনসভাতেই উপস্থিত জনতাকে প্রশ্ন করে চলেছেন,” কই, আপনাদের অ্যাকাউন্টে একটি টাকাও এল কী?”

এবারের ভোটের ফলাফল যদি বিজেপির পক্ষে আশাব্যঞ্জক না হয়, তীরে এসে তরী যদি ডোবে তখন কিন্তু দলের নেতা-কর্মীরাই বিদ্রোহ করবেন, মোদীকে তোলা হবে কাঠগড়ায়। তিনিই যে অসম্ভবকে সম্ভব করে পরপর দু’বার বিজেপিকে একক ক্ষমতায় সরকারে এনেছিলেন সেই চমৎকারিত্বের কথা সহসা বিস্মরণের অতলে চলে যাবে। ঠিক যেমনটি হয়েছিল ১৯৭৭-এর ভোটে কংগ্রেস ধরাশায়ী হওয়ার পরে, দল দু’ টুকরো হয়ে গিয়েছিল, হাতে গোনা যায় এমন কয়েকজন স্তাবক ব্যতিরেকে কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতারা প্রায় প্রত্যেকে ইন্দিরার সঙ্গ ত্যাগ করতে কাল বিলম্ব করেননি। বিজেপি অবশ্যই কংগ্রেস নয়, অনুশাসিত দল, অদ্যাবধি এই দলে কখনও ভাঙ্গন হয়নি। তদোপরি বিজেপির মাথার ওপরে আছে আর এস এস যাঁদের অভিভাবকত্বে ও অষ্টপ্রহর নজরদারিতে থাকতে হয় বিজেপিকে। তবু ভোটে ক্ষমতা খোয়ানোর পরে বিজেপির অন্দরেও মোদী একেবারেই স্বস্তিতে থাকবেননা, তাঁর দশ বছরের জমানায় দলের যে সব গুরুত্বপূর্ণ নেতা পর্দার অন্তরালে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা প্রত্যেকেই কিন্তু ধৈর্যের কঠিন পরীক্ষা দিচ্ছেন স্রেফ প্রত্যাঘাতের মুহূর্তটুকুর জন্য। ক্ষোভের ঢাকনা একবার খুলে গেলে কত যে দৈত্যের দাপাদাপি শুরু হবে কে বলতে পারে।

নরেন্দ্র মোদী যে ঘরানার রাজনীতি করেন তার ভিতরেই নিহিত আছে পতনের বীজ। অনেক কাল আগে সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে ইন্দিরা গান্ধিই প্রথম এ দেশে এই ঘরানার রাজনীতি আমদানি করেন এবং সাময়িকভাবে সফল হন। আমার মতে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদী সেই ইন্দিরার তৈরি টেমপ্লেটটি কতকটা অন্ধের মতো অনুসরণ করে চলেছেন। কিন্তু ওষুধের শিশির লেবেলে যেমন একটি ‘এক্সপায়ারি ডেট’ থাকে, এই গোত্রের রাজনীতিও তাই ধারাবাহিকভাবে সফল হয় না, হতে পারেনা। ইন্দিরা সফল হয়েছিলেন ১৯৭১-এর একটি মাত্র নির্বাচনে, তারপর তাঁরও ল্যাজে গোবরে অবস্থা হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদী উপর্যুপরি দুটি নির্বাচনে জিতে ইন্দিরার রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন বীরবিক্রমে। তদাপি তাঁর জয়রথ একদিন না একদিন কাদামাটিতে গেঁথে যেতে বাধ্য। সেই দিনটি সমাসন্ন কিনা এটাই ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পক্ষকাল আগে কোটি টাকার প্রশ্ন। উত্তরটি জানা যাবে ৪ জুন। ততদিন রাজা উজিরের গপ্পো বলাতো চলুক। (চলবে)

রাজা-উজির গপ্পো- প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন