Pataliputra: লক্ষ্মণপুর বাথের চিতায় পুড়ছিল দলিতরা, ব্রহ্মেশ্বরকে জবাব দিতে বিনোদ মিশ্রর চোখ জ্বলছিল

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: কুকুরগুলো বোবা। ডাকতে ভুলে গেছে। গ্রামে ঢুকে পুলিশের বুক কেঁপে গেল। জমাট রক্তের আঁশটে গন্ধে মাছি ভনভন করছে। রক্তের কাদা টপকে অফিসাররা ঢুকলেন…

প্রসেনজিৎ চৌধুরী:
কুকুরগুলো বোবা। ডাকতে ভুলে গেছে। গ্রামে ঢুকে পুলিশের বুক কেঁপে গেল। জমাট রক্তের আঁশটে গন্ধে মাছি ভনভন করছে। রক্তের কাদা টপকে অফিসাররা ঢুকলেন গ্রামের ভিতর। পায়ে পায়ে ঠোক্কর খাচ্ছে কার্তুজের খোলা। বেঁচে থাকা কয়েকজন ভয়ে চুপ। এদিক ওদিক ছড়িয়ে রুটির উপর পিঁপড়ের চাপ। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে আছে মৃতদেহ। কোথাও সার সার দেহ একসঙ্গে রাখা। এই সেই ভোজপুর জেলার মালহাদের (মাঝি সম্প্রদায়) লক্ষ্মণপুর বাথে গ্রাম। বহু আলোচিত।  ৫৮ জন দলিতের মৃতদেহে যখন আগুন দেওয়া হচ্ছে। অলক্ষ্যে চোখের জল শুকিয়ে আসা কেউ ফের বলল-বদলা। শুনেও মুখ ঘুরিয়ে নিলেন বিহার পুলিশের অফিসার। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় বুঝলেন আবার একটা ভয়ঙ্কর কিছু হবে। (Pataliputra)

ভোজপুর জেলা পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১ ডিসেম্বর, ১৯৯৭,  রাত ১১টার পরেই লক্ষ্মণপুর বাথে গ্রাম ঘিরে নেয় রণবীর সেনা। তারপর….। ‘নরসংহার’ এই শব্দটি দিয়ে পরের দিন ২ ডিসেম্বর সব হিন্দি সংবাদপত্রে লেখা হলো বহু আলোচিত লক্ষ্মণপুর বাথে গণহত্যার ঘটনা।  সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের খবরে দেশের সর্বত্র প্রবল আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। যেভাবে রণবীর সেনা পুরো গ্রাম ঘিরে নেয় তার বিবরণ যতটুকু জানা গিয়েছে পরিকল্পনা ছিল নিখুঁত।

“राजा बोला रात है राणी बोली रात है
मंत्री बोला रात है संत्री बोला रात है
यह सुबह सुबह कि बात है”- গোরখ পাণ্ডে

সকালে খবর আসে ভয়াবহ রাত কেমন ছিল। রাত পেরিয়ে রক্তাক্ত সকাল হয়। সারি সারি মৃতদেহের কথা জেনে যায় সবাই। ভয় ছড়িয়েছে। মন্ত্রী ভয় পায় গ্রামে তার বাড়িতে কী না জানি ঘটে গেল। আর শহরে যে কোনো সময় অপহরণ হতে পারে। পাটনার সচিবালয়ের ক্ষমতাধর আমলা ভীত-এই বুঝি কিছু হবে। তার পর চলবে টানাটানি। থানায় হামলার হুমকি আসছে-পুলিশ ভয়ে গুটিয়ে।  রাতের ট্রেন পশ্চিমবঙ্গ বা উত্তরপ্রদেশ থেকে বিহারে ঢুকলেই যাত্রীরা আতঙ্কিত। বিহার জুড়ে এমনই ভয়াল পরিবেশ। 

ঘড়ির কাঁটার মতো ভয় ঘুরে চলছিল বিহারের মাটিতে।  মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবের দল আরজেডি দলিত রাজনীতির ফসল। তবে ক্ষমতায় থাকার কারণে উচ্চবর্ণের সঙ্গে তাদের যোগ ভালোই। ‘পাওয়ার গেম’ জাত বর্ণ সব সরিয়ে ‘সত্তা’ (সরকার) ঘিরে ঘুরতে থাকে। এর বাইরে বিহারের গ্রাম মহল্লায় জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য যে যার সুবিধা মতো পক্ষ নেয়।

ভোজপুর, জেহানাবাদ, সিওয়ান, গয়া, পূর্ণিয়া, মুঙ্গের, পাটনা, বেগুসরাই, কোথাও রণবীর সেনা দলিতদের গ্রামে ঢুকে নরসংহার ঘটাচ্ছে। এর বদলা নিতে অতিবাম সংগঠন এমসিসি, জনযুদ্ধ গোষ্ঠি উঁচু জাতের গ্রামে ঢুকে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিচ্ছে। বিহারের মানচিত্র জুড়ে এই দুই পক্ষের মাঝে সরকার অসহায়। এই ভয়াবহ সময়ে বিহারের মাটিতে প্রতিপক্ষ দুই সংগঠন রণবীর সেনা ও সশস্ত্র অতিবামপন্থী দলগুলি। এরা কেউ কাউকে জমি ছাড়বে না। উচ্চ জাতভিত্তিক রাজনীতির সশস্ত্র পাহারাদার ব্রহ্মেশ্বর সিং। আর গরিব নিচু জাতের হয়ে সশস্ত্র রাজনৈতিক পথের নেতা বিনোদ মিশ্র। তিনি সিপিআইএমএল (লিবারেশন) শীর্ষ নেতা।

পশ্চিমবঙ্গে সত্তর দশকে সশস্ত্র নকশালবাড়ি বিদ্রোহ পুরোপুরি স্থিমিত হবার কিছু আগেই বিহারে এই ধারার রাজনীতি জমাট হয়ে যায়। তখন থেকেই নরশালপন্থীদের বিভিন্ন গোষ্ঠীভিত্তিক সংগঠন সক্রিয় হয়। তারই এক গোষ্ঠী মূলত তৎকালীন বর্ধমান জেলা থেকে বিহারে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই গোষ্ঠির অতিবামপন্থী নেতাদের মধ্যে অন্যতম বিনোদ মিশ্র। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর থেকে তিনি আরও গোপনে নতুন করে সশস্ত্র কৃষক আন্দোলনের পরিকল্পনা তৈরি করছিলেন। এক পর্যায়ে গঠিত হয় সিপিআইএমএল (লিবারেশন)। ১৯৭৫ সালে দলটির সাধারণ সম্পাদক হন বিনোদ মিশ্র।

মধ্যপ্রদেশ থেকে আসা বিনোদ মিশ্র কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) ছাত্র নেতা হিসেবে দুর্গাপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সংগঠন করতেন। সিপিআই থেকে তিনি সিপিআইএমের সংগে সংযুক্ত হন। এরপর ১৯৬৮ সালে সিপিআইএমের মধ্যে সাংগঠনিক নীতি বিতর্কে সশস্ত্র পথটি নেন চারু মজুমদার। সেই বছরই বর্ধমান জেলায় (এখন পূর্ব বর্ধমান) সিপিআইএমের সর্বভারতীয় বর্ধিত সভা (প্লেনাম) থেকে চারুবাবুর অনুগামীরা বেরিয়ে যান। এর ফল সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন। এই মতের সমর্থক হন বিনোদ মিশ্র।

নকশাল বিদ্রোহের মাঝে ১৯৭২ সালে কংগ্রেস ফের সরকার গঠন করে পশ্চিমবঙ্গে। আর জরুরি অবস্থার ধাক্কায় ১৯৭৭ সালে সিপিআইএম নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার হয়। এবার বিহারের মাটিতে রাজনৈতিক জমি শক্তিশালী করতে থাকেন বিনোদ মিশ্র। তাঁর রাজনৈতিক জীবন দীর্ঘ ঝঞ্ঝাময়। প্রতিপক্ষ সংগঠনই হোক বা রাষ্ট্রশক্তি, বারবার গুলির লড়াইয়ের মুখে দাঁড়িয়েছিলেন বিনোদ মিশ্র। বিহারের রাজনৈতিক ক্ষেত্র ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সর্বাধিক আলোচিত। এই সময়টিতে তিনি সিপিআইএমএল (লিবারেশন) দলকে শক্ত রাজনৈতিক জমির উপর দাঁড় করান। পুরো আশির দশক জুড়ে বিহার জুডে বিশেষত মধ্য বিহারে শাখা উপশাখা বিস্তার করতে থাকে অতি বামপন্থী সংগঠনগুলি। পারস্পরিক দ্বন্দ্বে নিজেদের মধ্যেও রক্ত ঝরেছে এদের। তবে সাংগঠনিক দিক থেকে লিবারেশন ক্রমে জনজীবনে ঢুকে যাচ্ছিল।

বিহারে বেরোজগারি যেমন বাড়ছিল, সেই সঙ্গে শুরু হয়েছিল নতুন ব্যবসা ‘ফিরৌতি’-মুক্তিপণ আদায়। তখন ধানবাদের কয়লা মাফিয়া সূরজদেও সিং আর সিওয়ানের ডন সাহাবুদ্দিন, বিহারের দুই প্রান্তের দুই ভয়। সশস্ত্র অতি বাম পথ না নিলেও বিহারের মাটিতে মাফিয়া রাজনীতি বিরোধী দুই নেতা ছিলেন ধানবাদের রায়বাবু অর্থাৎ এ কে রায় এবং পূর্ণিয়ার অজিত সরকার। এই  দুজনেই বিহার বিধানসভায় সিপিআইএমের চমক তৈরি করা নেতা। (চলবে)

গত পর্ব: Pataliputra: লণ্ঠণের হলদে আলোয় চোখ জ্বলে উঠত ব্রহ্মেশ্বর সিংয়ের, চিরকুটে দিত দাগ