গর্ব আমি ভারতীয়

ইয়ে পাবলিক হ্যায়, ইয়ে সব জানতি হ্যায়। এই সহজ, সরল সত্যটি রাজনীতিকরা জানেন না এমন নয়, ক্ষমতার অশ্বারূঢ হওয়ার পরে অনেক সময় বিস্মৃত হয়ে যান,…

Journalist Suman Chattopadhyay Analyzes Lok Sabha Poll Results

ইয়ে পাবলিক হ্যায়, ইয়ে সব জানতি হ্যায়।
এই সহজ, সরল সত্যটি রাজনীতিকরা জানেন না এমন নয়, ক্ষমতার অশ্বারূঢ হওয়ার পরে অনেক সময় বিস্মৃত হয়ে যান, এই মাত্র। বিস্মৃতি যখন ক্ষমতাসীনকে অন্ধ করে ঘোরতর বিচ্যুতি, দম্ভ, ঔদ্ধত্যের দিকে ঠেলে দেয়, যখন তাঁরা সমালোচনাকে শত্রুতা বলে মনে করেন, রাজদন্ডটিকে নিপীড়ন ও নিধনের জন্যই কেবল ব্যবহার করতে শুরু করেন, জনতা জনার্দনই তখন কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে কৃষ্ণের মতো রাজনীতির রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হন জনতার পরিত্রাণের জন্য।

ঐতিহাসিক দিক বদলের এমন ব্রাহ্ম মুহূর্ত একটি জাতির জীবনে ঘনঘন আসেনা, সত্যি কথা বলতে কী কদাচিৎ আসে। আমার জীবনে প্রথম তার দেখা পেয়েছিলাম যৌবনের গোড়ায়, ১৯৭৭ সালের ২৩ মার্চ তারিখে, যেদিন রেডিওয় খবর সম্প্রচারিত হোল ইন্দিরা গান্ধি পরাজিত হয়েছেন। তার ঠিক সাঁইত্রিশ বছর পরে সেই ব্রাহ্ম মুহূর্তটি ফিরে এল গতকাল ২০২৪ সালের ৪ঠা জুন। গত পরশু পর্যন্ত যাকে অসম্ভব বলে মনে হচ্ছিল, সবাই ধরে নিয়েছিলেন যেমন আছে তেমনই চলবে, জনতা সেই হতাশা, অবসাদ-জনিত বিভ্রান্তি দূর করে দিল সকলের অগোচরে, নীরবে, গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে। বিপথু শাসককে সবক শেখাল, দেবতার বরাভয়ের মতো ১৫০ কোটি মানুষকে জানিয়ে দিল, ‘যতক্ষণ আমি আছি ভাই, তোমার রাখাল লাগি কোনও ভয় নাই।’

   

আজ আমি ভারতীয় হিসেবে যৎপরোনাস্তি গর্বিত, আশ্বস্ত। বুকে জমে থাকা কোনও জগদ্দল পাথর নেমে গেলে যে মানসিক শান্তি হয়, শরীর-মনকে বাতাসের মতো হাল্কা লাগে, গত রাত থেকে আমি সেই অনির্বচনীয় তৃপ্তি অনুভব করছি।তা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগও করছি। এরপর ওপরওয়ালা ডেকে নিলেও আমি নিশ্চিন্তে প্রস্থানের জন্য প্রস্তুত।

আমি লোকসভা ভোটের ফলাফলের দলীয় জয়-পরাজয়ের ব্যবচ্ছেদ করতে বসিনি, আমার তাতে আগের মতো রুচিও নেই। আমি বড় ক্যানভ্যাসের ওপর যে বৃহত্তর ছবিটি আঁকা হয়ে রইল তার রেখাগুলিকে চিহ্ণিত করতে চাইছি মাত্র। অন্যভাবে বলতে গেলে আমার আগ্রহ এই ভোট দেশবাসীর কাছে যে বার্তাটি পৌঁছে দিল তা নিয়ে।জয়-পরাজয়ের হিসেব-নিকেশ, জয়ের আনন্দ, পরাজয়ের বিষাদ সবই তাৎক্ষণিক, আজ বাদে কাল ফিকে হয়ে যাবে। এসবের ঊর্ধ্বে এবারের ভোট যে বৃহত্তর সঙ্কেতগুলি দিয়ে গেল তাদের গুরুত্ব কিন্তু সুদূরপ্রসারী, ক্ষমতার রাজনীতির কুশীলবদের কাছে জরুরি শিক্ষামূলক।

বিজেপি এবারও একক গরিষ্ঠতা নিয়ে দিল্লি দখল করলে ভারতীয় সংবিধানের দফারফা করে ছেড়ে দিত, এদেশে ভবিষ্যতে আর কোনও দিন নির্বাচন হোতনা, কংগ্রেস বা তার সহযোগীদের এমন চরমপন্থী অবস্থানে আমার সায় ছিলনা, এখনও নেই। তবে বিরোধীদের অবিরত এই প্রচার সমাজের নীচের তলায় এবং সংখ্যালঘু মুসলিমদের একাংশকে অবশ্যই প্রভাবিত করেছে, বিরোধীরা তার ফায়দাও লুটেছে। সংবিধান শুধুই একটি কেতাব নয়, অনেক সাধনা, শ্রম, ত্যাগ, তিতিক্ষার ধন, আমাদের সবচেয়ে গর্বের উত্তরাধিকার। মুদ্রিত শব্দগুলি দেশের সর্বোচ্চ আইন যা সর্বার্থে অলঙ্ঘ।তার চেয়েও মহৎ বিষয়টি অবশ্যই সংবিধানের আত্মা বা হৃদপিন্ডটি, যাকে ইংরেজিতে বলে ‘কনস্টিটিউশনাল স্পিরিট অ্যান্ড ভ্যালুজ’। আত্মাটি বলে ভারতবর্ষ সবার দেশ, কোনও একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নয়। এই বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যই ভারতের মাথার তাজ। গত দশ বছর যাবৎ বিজেপি জমানায় এই স্বারস্বত সত্যটি আক্রান্ত হয়েছে বারবার, বিদেশে পরিচিত ভারতের গরিমা বারেবারে মসীলিপ্ত হয়েছে। ২০২৪ জানান দিয়ে গেল সংখ্যাগুরুর সর্বগ্রাসী আধিপত্যবাদ চলছেনা, চলবেনা। পিরিয়ড।

সবাই জানে প্রাচীন প্রবাদ অতি ব্যবহারের কারণে শ্রুতিমধুর হয়ত হয়না তবু তার গুরুত্ব ও চিরন্তনতা ক্রান্তিকালে নতুন ব্যঞ্জনা নিয়ে ফিরে ফিরে আসে, নতুন করে অনুভূত হয়। তেমনই একটি সনাতনী ইংরেজি প্রবাদ হোল, ‘পাওয়ার করাপ্টস, অ্যাবসলিউট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসলিউটলি।’ নরেন্দ্র মোদীর বিগত দশ বছরের জমানা এই প্রবাদটিকে একটু একটু করে সত্য প্রমাণ করার পরে জনমনে যে বিতৃষ্ণা, বিবমীষার জন্ম দিয়েছে তারই প্রতিফলন ঘটেছে ভোটের ফলাফলে।

একই ঘটনা ঘটেছিল ইন্দিরা গান্ধির ক্ষেত্রেও, মোদী চাইলে তা থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিতে পারতেন। তিনি অপারগ হওয়ায় গণদেবতা তাঁকে শিক্ষা দিয়েছে। ভাবীকালের যে কোনও শাসকের কাছে এই শিক্ষা স্মরণীয় থাকা উচিত যদিও জানি রাজনীতিকরা ভালো শিক্ষার্থী হতে পারেননা, নিরঙ্কুশ ক্ষমতার মদিরা পানের পরে তাঁরা ধরাকে সরাজ্ঞান করতে শুরু করেন, সাম-দাম-দন্ডভেদের দিকে ঢলে পড়েন, নাগরিক সমাজ, স্বাধীন সাংবিধানিক সব সংস্থা, গণমাধ্যম, মায় বিচার বিভাগের কাছ থেকেও নিঃশর্ত বশ্যতা দাবি করেন, অবাধ্যকে পদানত করেন ভয়, ত্রাস আর নিপীড়নের জন্য রাষ্ট্রের বিবিধ তদন্ত সংস্থার অপব্যবহার করে, মনে করেন সংসদের অন্দরে মাথাভারী হওয়ার অর্থ যথেচ্ছাচারের লাইসেন্স পেয়ে যাওয়া। এই ঔদ্ধত্য, ক্ষমতার দম্ভ যখন বন্যার আগে নদীর জলসীমা বৃদ্ধির মতো সহ্যশক্তির ওপরে ওঠে তখনই সত্য হয় গীতার অমোঘ বানী। ‘ পরিত্রাণায় সাধুনাং, বিনাশায় চ দুষ্কৃতম, ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।’

ব্যক্তি, তিনি যতই জনপ্রিয় হোন,যত বড় বাগ্মী হোন কিংবা মোহিনী শক্তির অধিকারী, গণতন্ত্রে, বহুদলীয় ব্যবস্থায় তিনি কখনও দলীয় সংগঠন এবং ব্যাপকার্থে দেশের সম্মিলিত শক্তির বিকল্প হতে পারেননা। তাঁকেও সংযম, সহনশীলতা, পরমত সহিষ্ণুতা, সকলকে নিয়ে চলা, যোগ্যকে প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে আত্ম-সংবরণের লক্ষণরেখার মধ্যেই থাকতে হয়। তার অন্যথা হলেই সর্বনাশ। সত্তরের দশকের মাঝামাঝিএই পথে চলতে গিয়ে নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে এনেছিলেন ইন্দিরা গান্ধি। এবার নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। ২০২৪ ভবিষ্যতের শাসককে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল ‘ অতি বাড় বেড় নাকো ঝড়ে পড়ে যাবে।’ যাবেই।

গণতন্ত্রে শাসক কখনও নাগরিকের প্রভুর আসনে বসতে পারেননা। তিনি জনতার সেবক। তবু কী সবাই দেওয়ালের স্পষ্ট লিখন পড়তে পারেন? পড়লে ভালো, অন্যথায় প্রথমে স্খলন, তারপরে পতন।