অতিমারি আর আংশিক লকডাউন সামলে কীভাবে চলছে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি

নন্দিনী চট্টোপাধ্যায়: দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর ধরে আমরা অতিমারি পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলেছি। এই দীর্ঘ সময় কখনো সংক্রমণের প্রকোপ খুব জোরালো ছিল আবার কখনো কিছুটা…

Bengal’s film industry

নন্দিনী চট্টোপাধ্যায়: দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর ধরে আমরা অতিমারি পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলেছি। এই দীর্ঘ সময় কখনো সংক্রমণের প্রকোপ খুব জোরালো ছিল আবার কখনো কিছুটা কম। সংক্রমণের প্রথম ধাক্কায় মানবজীবন বেশ কিছুকাল থমকে গিয়েছিল, পরবর্তীকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব‍্যাতীত সবক্ষেত্রেরই দ্বার অল্পবিস্তর উন্মোচন হয়েছে। সবাই নিউ নর্মালে অভ‍্যস্ত হয়ে উঠেছে। তবে গত দেড় বছর ধরে করোনাকালে বহু মানুষের জীবনযাত্রা পাল্টে গেছে। বলা যায় সবাই কমবেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিও এই করোনার ধাক্কায় যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই বিপুল ক্ষতি সামলে নিউ নর্মালে তারা কিভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন তা জানার জন্য মুখোমুখি হওয়া গেল এই রুপোলি পর্দার জগতের সঙ্গে জড়িত কিছু বিশেষ ব‍্যক্তির। কি বলছেন এই পেশার সাথে যুক্ত মানুষেরা,

পরিচালক অভিমন্যু মুখার্জী বলেন, ” কাজ তো চলছেই কাজ আটকে নেই । গত বছর যখন লকডাউন হয়েছিল তারপর তা ওঠার পর যেমন কাজ শুরু হয়েছিল তেমনি এবার লকডাউনের পরও টেলিভিশন ,ফিল্ম ,ওয়েব সিরিজ- প্রত‍্যেক প্ল‍্যাটফর্মেরই কাজ চলছে। সমস্যা একটাই যে এতদিন সিনেমা হল বন্ধ থাকায় যে ছবিগুলো মুক্তির অপেক্ষায় ছিল তারা সমস্যায় পড়েছে। আমারও দুটো ছবি আটকে আছে। সম্প্রতি রাজ‍্যসরকারের নির্দেশিকায় এবার পঞ্চাশ শতাংশ দর্শক নিয়ে হল খুলছে। তাই এবার ভাবনা চিন্তা শুরু হবে।

তবে অতিমারির আগের পরিস্থিতির সঙ্গে তফাৎ তো একটা আছেই , আগে কোভিড বিধি মানার কোন ব‍্যাপার ছিল না। কিন্তু এখন শুটিং করার সময় অনেক নিয়মের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। যেমন – শুটিংয়ের স্থানটি পুরোপুরি স‍্যানিটাইজেশন করে নিতে হয়। অভিনেতা- অভিনেত্রী ছাড়া সবাইকে মাস্ক পড়তে হয়। এছাড়া আরও নানান নিয়মাবলী আছে। এখন রাত ৯ টা থেকে যেহেতু নাইট কার্ফু চালু হয় তাই রাত ৮ টার মধ্যে প‍্যাকআপ করে দিতে হয়। সুতরাং সব মিলিয়ে একটা বদল তো এসেছেই । করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় মানুষ সেই পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত ছিল না, তাই অনেকেই কর্মসংস্থান হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে । আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রির অনেক মানুষই তখন অন‍্যের কাছে হাত পাততে বাধ্য হয়। আমরা অনেকেই তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই। যাতে কাউকে উপোস করে থাকতে না হয়। আমরা সবাই চাই এই করোনাকাল থেকে দ্রুত মুক্তি এবং করোনার তৃতীয় ঢেউ যেটা আসছে তার প্রকোপ আমাদের ওপর যেনো সেভাবে না পড়ে। খারাপ তো হয়েছেই , কিন্তু সেই খারাপের ম‍ধ‍্যেই ভালোকে খুঁজে নেওয়ার প্রয়াস চলছে। ”

সিনেমাটোগ্রাফার সৌরভ ব‍্যানার্জীর কথায় , ” লকডাউনের প্রভাব ভীষণভাবে বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে পড়েছে। দীর্ঘদিন সবাই কর্মহারা হয়েছিল। অনেক ইলেকট্রিশিয়ান ও অন্যান্য বেশ কিছু বন্ধু বাধ্য হয়ে প্রফেশন পাল্টে আলু – পটল বিক্রি করছে আবার কেউ অটো চালাচ্ছে। সবার খুবই করুন অবস্থা। আমাকেও সমস্যায় পড়তে হয়েছে , সব কাজগুলি স্থগিত হয়ে যায়। আর তার থেকেও বড় সমস্যা হয়েছে যে, লকডাউনের পরবর্তীকালে যে কাজগুলো হচ্ছে সেগুলোর বাজেট একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। তাই একটা কাজের পেছনে আমাদের যে সময় দিতে হচ্ছে তার উপযুক্ত পারিশ্রমিকের তুলনায় অনেকটাই কম অর্থ মিলছে। এই ভাবে যদি দীর্ঘদিন চলতে থাকে তাহলে তা হবে বাংলা ইন্ডাষ্টির জন্য একটা ভয়ানক ব‍্যাপার। আমার প‍্যানেলেই এখন পাঁচটা ছবি তৈরি হয়ে আছে কিন্তু রিলিজ করা যাচ্ছে না। যে সময় ছবিগুলি তৈরি হয়েছিল তখন তো আমরা জানতাম না এই রকম পরিস্থিতি তৈরি হবে, তাই হলের জন‍্যই তৈরি করা হয়েছে। ছবিগুলি ও.টি.টি – র প্ল‍্যান করে তৈরি হয় নি। তাই প্রডিউসারদের খুবই সমস্যার মধ্যে দিয়ে চলতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারের সাহায্যের খুবই প্রয়োজন।

পরিচালক সমীক রায়চৌধুরী জানালেন, ” ২০২০ সালের মার্চ মাসে আমার ‘বেলাইন’ ছবি শুরুর কথা ছিল, কিন্তু লকডাউন শুরু হওয়ায় সেই ছবির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে ঐ ছবির কাজই করতে হয়েছে অনেক কম বাজেটে। কারন আমাদের মতো প্রডিউসাররাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমরা কাজটাকে একটা ভালো পরিনতি দেওয়ার চেষ্টা করছি। তবে কাজটা করতে গিয়ে অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যেমন – আগের মতো টেকনিশিয়ান নেওয়া যাচ্ছে না ,আবার রাতের দৃশ্য টেক করার সময়সীমা খুবই কম। কারন রাত ৮ টার মধ্যে প‍্যাকআপ করতে হচ্ছে। একটা সীমাবদ্ধতা থেকে যাচ্ছে। অন‍্যদিকে কোভিডের তৃতীয় ঢেউ আসার আগেই যাতে কাজটা শেষ করা যায় সেদিকেও নজর রেখে একটু তাড়াহুড়ো করেই ছবির কাজ শেষ করতে হবে। তবে আমরা সবাই চেষ্টা করছি ছবিটির গুনগত মান যেন বজায় থাকে। কারন এই ছবিটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ও এন্টারটেইনমেন্ট উভয় ক্ষেত্রের কথা মাথায় রেখে তৈরি হচ্ছে।”

সিনেমাটোগ্রাফার প্রসেনজিৎ কোলে খুব হতাশাগ্রস্ত ভাবে বলেন, ” গত বছর অতিমারি শুরুর সময় আমার একটা বড় কাজের শিডিউল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। সেটা শুধু আমার ক্ষেত্রে নয় , অন‍্যান‍্য সবাইকেই ভুগতে হয়েছে। আমার নিজের ক্ষেত্রে অন্তত চারটে কাজ বন্ধ হয়। গত বছর ইউ এস এ আমার দুটো শ‍্যুট করতে যাওয়ার ছিল একটা ফিচার ফিল্ম ও একটা শর্ট ফিল্ম। কিন্তু সেটা বাতিল হয়ে যায়। তারপর লকডাউন উঠে যাওয়ার পর পুজোর আগে থেকে অল্প কাজ শুরু হয় , ধীরে ধীরে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিকও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মার্চের পর কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়লে সব ডেট পিছিয়ে যায়। এখন কাজ শুরু হয়েছে তবে সামনেই আবার তৃতীয় ঢেউয়ের অপেক্ষা। গতবছর ইউ এস এ যে ছবিটির শুটিংয়ের কথা ছিল তার নতুন শিডিউল হয়েছে সেপ্টেম্বরে , আমার টিকিটও হয়ে গেছে তবে ভিসা পাব কিনা জানি না। বা সে সময়ের পরিস্থিতি কি হবে সেটা ও অজানা। আমরা এক ঘোরতর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। আমাদের এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এত মানুষ কাজ করে কিন্তু এটা কারও স্থায়ী কাজ নয়, সবাই ফ্রিল্যান্সার। তাই সবার ক্ষেত্রেই বিষয়টি বড় সমস্যার। এই যে বারে বারে লকডাউন হচ্ছে এরফলে কিছু কাজের আবার নতুন শিডিউল হচ্ছে কিন্তু অনেক কাজই শুরুর আগেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এটা আমাদের ইন্ডাস্ট্রির একটা বড় রকমের ক্ষতি।”

আর্ট ডিরেক্টর তপন কুমার শেঠের মতে, “লকডাউনের আগে আমরা অনেক স্বাচ্ছন্দ্যভাবে কাজ করতে পারতাম কিন্তু এখন সব সময়ই একটা ভয় কাজ করে। এখন কেউ কারো কাছে যাবে না, কেউ কারো সঙ্গে হাত মেলালে হাত স‍্যানিটাইজ করা, আগে যাদের সঙ্গে সেটে দেখা হলে জড়িয়ে ধরতাম এখন জড়িয়ে ধরার তো প্রশ্নই নেই বরং মনে হয় দূরে গেলেই বাঁচি। একটা অশ্পৃশ‍্যর মতো ব‍্যাপার হয়ে গেছে। কিন্তু এরমধ্যে থেকেই কাজ করতে হবে। কারন এমনি মরার থেকে খেয়েই না হয় মরি, তাই আমরা কাজটা করছি। কোন উপায় নেই, না হলে গোটা পরিবার শেষ হয়ে যাবে। এই ইন্ডাস্ট্রিতে প্রায় সাড়ে পাঁচ – ছয় হাজার টেকনিশিয়ান, এই লকডাউনে সবাই প্রায় বসে ছিলাম। আমাদের অন্য কোন রোজগার তো নেই। তাই লকডাউনের সময় অনেকেই সংসার বাঁচানোর তাগিদে মাছের ব‍্যবসা বা সবজির ব‍্যবসা করেছেন। কিন্তু আমরা যারা হাতের কাজ করি আমরা এমন একটা জায়গায় আছি যে ঐ জায়গায় পৌঁছাতে পারবো না। ভাগ্য ভালো এবারের লকডাউনটা অল্পদিনের ছিল। না হলে ব‍্যাঙ্ক ব‍্যালান্স শেষ হয়ে যাচ্ছিল, খুব চিন্তায় ছিলাম যে শেষ অবধি না জিনিস বন্ধক দিতে হয় বা বিক্রি করতে হয়। যদিও ফেডারেশন সব সময় আমাদের পাশে ছিল। দুঃস্থ টৈকনিসিয়নদের অনেকভাবে সাহায্য করেছে।

গতবার লকডাউনের সময় বিগ বাজারের কুপন ও টাকা দেওয়া হয়েছিল। আমরা যারা পেরেছি তারাও ফেডারেশনের পাশে ছিলাম। আমার সঙ্গে যারা কাজ করে তাদেরকেও যতটা সম্ভব সাহায্য করেছি। এই ভাবে আমরা সবাই সবার পাশে ছিলাম , তাই ইন্ডাস্ট্রিটা আজও টিকে আছে। ফেডারেশন থেকে সবাইকে নিরখরচায় ভ‍্যাকসিনও দেওয়া হচ্ছে। এখন কাজ আবার জোড়কদমে চলছে। তবে যাদের কাজের চাহিদা বেশি তারাই কাজটা পাচ্ছেন। এই মুহূর্তে আমি মৈনাক ভৌমিক , রাজ চন্দ্রের ছবির কাজ শেষ করলাম। সমীক রায়চৌধুরীর ছবির কাজ চলছে । তাছাড়া অ্যাডফিল্ম এবং ও.টি.টি প্ল‍্যাটফর্মের কাজ ও রয়েছে। তবে এখন একটা বড় সমস্যা হল এই অতিমারির কারনে ছবির বাজেট অনেক কমে গেছে। আর এই সুযোগটা অনেক প্রডিউসার নিচ্ছেন। যাদের কোন অসুবিধা নেই তারাও কম টাকা দিচ্ছেন। প্রতিযোগিতার বাজারে আমাকে লোকসান জেনেও কাজ নিতে হচ্ছে। কিন্তু এই ব‍্যাপারটা দীর্ঘায়িত হলে আমাদের খুবই সমস্যায় পড়তে হবে। ” জানালেন ছবির আর্ট ডিরেক্টর তপন শেঠ।

আরেকজন আর্ট ডিরেক্টর সাগর দাশগুপ্ত জানালেন, ” অতিমারির আগে যেভাবে সিরিয়াল, সিনেমা এবং ও.টি.টি প্ল‍্যাটফর্মের কাজ চলছিল লকডাউনের পরবর্তীকালে কাজের সেই গতি নষ্ট হয়ে গেছে। সিরিয়ালগুলি পূর্বের ন‍্যায় চালু হলেও সিনেমার শুটিং আর সেভাবে হচ্ছে না। তবে ও.টি.টি প্ল‍্যাটফর্মের কাজও যথেষ্ট হচ্ছে। আমরা যারা সিরিয়ালের কাজ করি না, তারা খুবই সমস্যায় পড়েছি। যারা সিরিয়ালের সঙ্গে জড়িত তারা প্রত‍্যেক মাসে নির্দিষ্ট একটা অর্থ উপার্জন করে। কিন্তু আমাদের কাজ না থাকলে রোজগারের পথও বন্ধ। গতবছর লকডাউনের পর ইউনিটের কারো করোনায় প্রানহানি হলে একটা ইন্সুরেন্স চালু হয়েছিল , মাঝে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এখন পুনরায় চালু হওয়ায় প্রডিউসাররা ২৫ লক্ষ টাকা ইন্সুরেন্স এর ভয়ে সিনেমা তৈরির ক্ষেত্রে অনেকেই পিছিয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া দীর্ঘদিন সিনেমা হল বন্ধ থাকাটাও একটা কারন। এতে কাজের পরিধি আরো সঙ্কুচিত হয়েছে। তাছাড়া আমাদের একটা কাজ পাওয়ার জন্য অনেক প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় , এরপর কাজ করার পর সেই কাজের পারিশ্রমিক পাওয়ার জন্যও একটা ফাইট করতে হয়। কিন্তু এই লকডাউনের জন্য আমাদের সেই ফাইট আরো কঠিন হয়ে গেছে। তাই আমরা একটা সাঙ্ঘাতিক আর্থিক অনটনের মধ্যে দিয়ে চলেছি। ”

অনেক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে গিয়েও বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি মুখ থুবড়ে পড়ে নি। পারস্পারিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে চলেছে। সম্প্রতি রাজ‍্যসরকার পঞ্চাশ শতাংশ দর্শক নিয়ে সিনেমা হল খোলার নির্দেশ জারি করেছে। তাই আশা করা যাচ্ছে ধীরে ধীরে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির সুদিন পুনরায় প্রত‍্যাবর্তন করবে।