গোয়েঙ্কা মাল কামাচ্ছেন, ঝুঁকছে সরকারি পর্ষদ

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে প্রতি বছর নিয়ম করে বিদ্যুতের মাসুল (Electricity bill) বৃদ্ধি ঘটে আসছে। ব্যতিক্রম শুধু ২০২০ এবং ২০২১– অতিমারির কারণে ওই দুই…

CESC Owner Goenka Profits by Relying on Government Electricity Board

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে প্রতি বছর নিয়ম করে বিদ্যুতের মাসুল (Electricity bill) বৃদ্ধি ঘটে আসছে। ব্যতিক্রম শুধু ২০২০ এবং ২০২১– অতিমারির কারণে ওই দুই বছর বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট মূল্য অপরিবর্তিত ছিল।

অনেক বিরোধী দলকেই বলতে শুনি, বিদ্যুতের মূল্য সারাদেশে সবচেয়ে বেশি এই পশ্চিমবঙ্গে। এই তথ্য একেবারেই ভূল। দেশের মধ্যে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয় মুম্বইয়ে। তারপর আহমেদাবাদ শহরে। পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট মূল্যের ক্ষেত্রে তৃতীয় স্থানে। এবং ভাল দিক যদি বলতে হয়, তাহলে বলতেই হবে — কোয়ালিটি পাওয়ার সাপ্লাইয়ের ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গ সারা দেশের মধ্যে কখনও প্রথম, কখনও দ্বিতীয়, কখনও বা তৃতীয় স্থানে থাকে। এবার খারাপ দিকগুলি কী কী ? আর কেনওই বা বাড়ে বিদ্যুতের দাম এমন বেলাগাম ভাবে?

   

বেলাগাম মূল্যবৃদ্ধির জন্য বহুলাংশে দায়ী এই রাজ্যের সরকার। সারা রাজ্যকে নীল সাদা রঙ আর আলোয় মুড়ে দিয়েছে ঠিকই– কিন্তু রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতর, এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর নিজের পুলিশ দফতর থেকেও গত বারো বছরে শুধুমাত্র রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির পাওনা ৫৬ হাজার কোটি টাকারও কিছু বেশি। এই টাকা কিন্তু রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন সংস্থা, আমার আপনার পকেট থেকে নিতে না পারলেও, সিইএসসি নিয়ম করে ওই বকেয়া টাকা ঘুরপথে আমার আপনার পকেট থেকে নিচ্ছে প্রতি মাসে। আর বকেয়া টাকা না পেয়ে রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন সংস্থার ( ডিসিএল) হাল এখন আইসিইউতে চলে গিয়েছে। কোনও ব্যাঙ্ক এখন আর ডিসিএলকে ঋণ দেয় না। ডিসিএলকে ঋণ নিতে হয় কাবুলিওয়ালাদের মতো সংস্থা — রুরাল ইলেকট্রিসিটি কর্পোরেশন বা আরইসি থেকে। গত তিন বছর হল ডিসিএলের (যার নাম আগে ছিল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ ) হয়ে কোনও সিনিয়র কাউন্সিল সুপ্রিম কোর্টে মামলা লড়তে চায় না– হার নিশ্চিত জেনে।

অথচ কী বৈপরীত্য দেখুন, সঞ্জীব গোয়েঙ্কার সঙ্গে শাসকদলের সখ্যতা থাকার ফলে সিইএসসি কিন্তু প্রতি বছর তার নেট প্রফিট এক হাজার কোটি টাকা ছুঁয়ে ফেলেছে। নিয়ম করে তারা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ সংবহন কোম্পানি ( টিসিএল ) এবং ডিসিএলের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনে তার দাম সময় মতো না মিটিয়েও বহাল তবিয়তে রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সঞ্জীবাবুর সখ্যতা এতটাই গভীর যে সিইএসসিকে সবক শেখাতে উদ্যোগী হওয়ার কারণে বিদ্যুৎ দফতর থেকে সরতে হয় একে একে গোপালকৃষ্ণ, এস কিশোর এবং নারায়ণস্বরূপ নিগমের মতো কৃতী, সৎ, নিষ্ঠাবান আমলাকে। বসানো হয় মুখ্যমন্ত্রীর বশংবদ আমলা শান্তনু বসুকে। যিনি আবার শুধু বিদ্যুৎ দফতর নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে তথ্য সংস্কৃতি দফতর, রাজ্য বিদ্যুৎ সংবহন কোম্পানি এবং রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর। এত দায়িত্ব এক হাতে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সামলাতে পারতেন কি না বলা যাবেনা।

এবার আসি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে। বিদ্যুতের দামের ক্ষেত্রে তিন রকমের ক্যাটাগরি থাকে। এগ্রিকালচার। ডোমেস্টিক। কমার্শিয়াল। যেখানে এগ্রিকালচার গ্রাহকদের জন্য বিদ্যুতের দাম যদি ধরি ইউনিট প্রতি দু টাকা তিরিশ পয়সা, সেখানে ডোমেস্টিক গ্রাহকদের জন্য ন্যুনতম দাম ইউনিট প্রতি পাঁচ টাকা। আর কমার্শিয়াল নয় টাকা। তৃণমূল কংগ্রেসের পঞ্চায়েত প্রধান থেকে শুরু করে পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যদের শতকরা আশি শতাংশ নিজেকে কৃষক প্রমাণিত করে এগ্রিকালচার কানেকশন নিয়ে সব রকম বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম চালান নিজেদের বাড়িতে। এর পরেও বিদ্যুতের বিল অনাদায়ী থাকে এবং রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ-এর ক্ষমতা নেই সেই সংযোগ কেটে দেয়। এই ভাবেই চলছে ২০১২ থেকে আজ অবধি। ২০১১ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগণার মগরাহাটে পর্ষদের লোকেরা বেআইনি কানেকশন কাটতে গিয়ে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে মার খায়। পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয় এবং তাতে প্রাণ যায় দুই গ্রামবাসীর। তারপর থেকে মুখ্যমন্ত্রীর নিষেধাজ্ঞা জারি– কোনও রকম রেইড করা চলবে না। যার ফলে ২০০৮ পর্যন্ত যে সংস্থা লাভজনক ছিল, তা আজ ভেন্টিলেশনে।

আরও একটি বড় কারণ বিদ্যুৎ কেনা বেচার চুক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখালেও সিইএসসির বিরুদ্ধে কোনও রকম আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ। রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ-এর সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদি পাওয়ার পার্চেজ এগ্রিমেন্ট থাকার পরেও যত বিদ্যুৎ প্রতিদিন সিইএসসির কেনার কথা, তার একশো ভাগের দশভাগ-ও সঞ্জীববাবুর সংস্থা কেনে না। এ ছাড়াও ২০১৪ পর্যন্ত রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ-এর সবচেয়ে বড় গ্রাহক ছিল ভারতীয় রেল। ২০১৪ সালের শেষের দিক থেকে ভারতীয় রেল সরাসরি স্টেট গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ কেনে। শুধুমাত্র ডোমেস্টিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিক্রি করে কোনও বন্টন সংস্থা চলতে পারে না। বন্টন সংস্থা লাভ করে বালক্ কনজিউমারকে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারলে। পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের শ্মশানযাত্রার ফলে বন্টন সংস্থা আজ ভেন্টিলেশনে।

বিদ্যুৎ বিলের ছলচাতুরির বিষয়ে আসা যাক এবার।সিইএসসির প্রতিমাসের বিল দেখে আইনস্টাইন-ও বুঝতে পারবেন না ঠিক কোন স্ল্যাবে সঞ্জীববাবুর কোম্পানি তাকে কত টাকা চার্জ করেছে। শুধু বার ডায়াগ্রাম থাকে পেছনের পাতাতে গত বছর আপনি মার্চ মাসে কত ইউনিট কনজিউম করেছেন, আর এই বছর মার্চ মাসে আপনার কত ইউনিট চাহিদা ছিল। কোনও গ্রাহক গতবছরের বিল খুঁজে বের করে মেলানোর চেষ্টা করেন বলে আমি অন্তত জানি না। ভারত সরকারের ঘোষিত আইন অনুযায়ী প্রতি গ্রাহকের প্রথম একশো ইউনিট ফ্রি। যা তামিলনাড়ু সরকার ২০০ ইউনিট ফ্রি দিয়ে থাকে, তেলেঙ্গানা সরকার ১৫০ ইউনিট দেয়, এবং প্রায় সব উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি এক নিয়মে চলছে। বাম জমানার শেষভাগে একশো ইউনিট করে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ পেত জনসাধারণ। আর তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের জমানায় তা সিইএসসি অঞ্চলে ২৫ ইউনিট। এবং পর্ষদ এলাকায় পঞ্চাশ ইউনিট করে দেওয়া হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর নামে পোস্টার মেরে।