ভারত এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে সম্প্রতি স্বাক্ষরিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (India-UK FTA) স্কচ (Scotch) হুইস্কির উপর শুল্ক কমানোর মাধ্যমে ভারতের প্রিমিয়াম হুইস্কি প্রস্তুতকারীদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। এই চুক্তি অনুযায়ী, যুক্তরাজ্য থেকে আমদানি করা হুইস্কি এবং জিনের উপর শুল্ক ১৫০% থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ৭৫%-এ এবং আগামী এক দশকের মধ্যে ৪০%-এ নামিয়ে আনা হবে। এই পদক্ষেপ বিশ্বের বৃহত্তম হুইস্কি বাজারে প্রিমিয়াম স্পিরিটকে আরও সাশ্রয়ী করে তুলবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে, এই শুল্ক হ্রাস কি ভারতের হুইস্কি বাজারকে আমূল রূপান্তরিত করবে, নাকি দেশীয় শিল্পের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে? এই প্রতিবেদনে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
দেশীয় প্রিমিয়াম হুইস্কি প্রস্তুতকারীদের আশাবাদ
ভারতের শীর্ষস্থানীয় হুইস্কি প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলো, যেমন র্যাডিকো খৈতান, অ্যালাইড ব্লেন্ডার্স অ্যান্ড ডিস্টিলার্স (এবিডি) এবং জন ডিস্টিলারিজ, এই চুক্তিকে তাদের মুনাফা বৃদ্ধি এবং ব্যবসায়িক প্রসারের সুযোগ হিসেবে দেখছে। র্যাডিকো খৈতান, যারা ‘রামপুর’ সিঙ্গল মাল্ট এবং জয়সালমের ইন্ডিয়ান ক্রাফট জিনের জন্য বিখ্যাত, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ২৫০ কোটি টাকার স্কচ মাল্ট আমদানির পরিকল্পনা করেছে। সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক অভিষেক খৈতান এই এফটিএ-কে “উল্লেখযোগ্য খরচ সুবিধা” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। শুল্ক হ্রাসের ফলে কাঁচামালের খরচ কমবে, যা তাদের পণ্যের মূল্য প্রতিযোগিতামূলক করতে এবং মুনাফা বাড়াতে সহায়ক হবে।
একইভাবে, অফিসার্স চয়েস হুইস্কির প্রস্তুতকারক এবিডি জানিয়েছে, এই চুক্তি তাদের সুপার-প্রিমিয়াম থেকে লাক্সারি পণ্যের পরিসরকে আরও অ্যাক্সেসযোগ্য করবে। সংস্থার এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “এই চুক্তি ভারতীয় গ্রাহকদের জন্য উচ্চমানের স্পিরিটের বিস্তৃত পছন্দ এবং সুযোগ প্রদান করবে।” শুল্ক হ্রাসের ফলে প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নির্ধারণ সম্ভব হবে, যা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের সঙ্গে সহযোগিতার নতুন পথ খুলে দিতে পারে। জন ডিস্টিলারিজের চেয়ারম্যান পল পি জনও এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন, তবে তিনি বলেছেন, মূল্য নির্ধারণের কৌশল নিয়ে এখনই মন্তব্য করা সম্ভব নয়। তিনি আশা করছেন, এই চুক্তি যুক্তরাজ্যে ভারতীয় ব্র্যান্ডের বাজার প্রবেশকে সহজ করবে।
দেশীয় শিল্পের উপর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ
তবে, সব শিল্প নেতা এই শুল্ক হ্রাসের বিষয়ে আশাবাদী নন। আমরুট ডিস্টিলারিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রক্ষিত এন জগদালে এই তীব্র শুল্ক হ্রাসের সমালোচনা করে বলেছেন, এটি ভারতের দেশীয় অ্যালকোহল শিল্পের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তিনি সতর্ক করে বলেন, “এই পদক্ষেপ ভারতীয় পাতন শিল্পের ভবিষ্যৎ প্রসার প্রকল্পগুলোকে নিরুৎসাহিত করতে পারে, যা উৎপাদন জিডিপিতে অবদান রাখে এবং কৃষি থেকে খুচরা পর্যন্ত সরবরাহ শৃঙ্খলে উল্লেখযোগ্য সরাসরি ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে।” তিনি আরও বলেন, স্কচ আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোর রপ্তানির তুলনায় বেশি হতে পারে, যা স্থানীয় শিল্পের প্রতিযোগিতার ক্ষতি করবে।
জন ডিস্টিলারিজের পল পি জনও স্বল্পমেয়াদে দেশীয় বিক্রির উপর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “চুক্তির বিস্তারিত চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত এর প্রভাব মূল্যায়ন করা কঠিন।” এছাড়া, কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান অ্যালকোহলিক বেভারেজ কোম্পানিজ (সিআইএবিসি)-এর ডিজি অনন্ত এস আইয়ার সতর্ক করে বলেছেন, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে এই শুল্ক হ্রাসের ধাঁচ যদি ইইউ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য স্পিরিট উৎপাদনকারী দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে অনুসরণ করা হয়, তাহলে ভারতের অ্যালকোহল শিল্প, বিশেষ করে ওয়াইন খাত, ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে মহারাষ্ট্র, কেরালা, ওড়িশা, রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলোকে আমদানি করা মদের উপর আবগারি শুল্ক ছাড় পর্যালোচনার পরামর্শ দিয়েছেন।
বাজারের প্রবৃদ্ধি এবং গ্রাহকের পছন্দের পরিবর্তন
স্কচ হুইস্কি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ভারত স্কচের পরিমাণের দিক থেকে বৃহত্তম বাজার ছিল, যেখানে ১৯২ মিলিয়ন বোতল রপ্তানি হয়েছে। তবে, মূল্যের দিক থেকে ভারত চতুর্থ স্থানে রয়েছে, রপ্তানি মূল্য ২৪৮ মিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড। অন্যদিকে, সিআইএবিসি জানিয়েছে, ২০২৩ অর্থবছরে ইন্ডিয়ান মেড ফরেন লিকার (আইএমএফএল)-এর বিক্রি পরিমাণের দিক থেকে ১৪% বৃদ্ধি পেয়ে ৩৮৫ মিলিয়ন কেসে পৌঁছেছে। এর মধ্যে ৭৫০ মিলি বোতলের জন্য ১,০০০ টাকার বেশি মূল্যের প্রিমিয়াম পণ্যগুলো শিল্পের গড়ের তুলনায় তিন গুণ বেশি, অর্থাৎ ৪৫% বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভারতের সিঙ্গল মাল্ট ব্র্যান্ডগুলো, যেমন আমরুট, পল জন, ইন্দ্রি, রামপুর এবং গিয়ানচাঁদ, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডগুলোকেও অতিক্রম করেছে। তবে, শিল্প নেতারা সতর্ক করে বলেছেন, সুষম বাণিজ্য নীতির অভাবে স্কচ আমদানির উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি এই দেশীয় সাফল্যের গল্পগুলোকে ম্লান করে দিতে পারে।
সরকারের দৃষ্টিকোণ এবং অর্থনৈতিক প্রভাব
সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুল্ক হ্রাসের ফলে দেশীয় বাজারে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে না, কারণ এটি দশ বছরের দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ধীরে ধীরে কার্যকর হবে। ভারতের হুইস্কি বাজারে দেশীয় মদ ৮৮% এবং আইএমএফএল ৯.৫% অংশ নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে স্কচ মাত্র ২.৫%। কর্মকর্তারা আরও বলেন, শুল্ক হ্রাস বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়াতে এবং যুক্তরাজ্যের উন্নত প্রযুক্তি ও বিপণন কৌশলের সুবিধা গ্রহণে সহায়ক হবে। এছাড়া, কম শুল্ক রাজস্ব সংগ্রহ বাড়াবে, কর সংগ্রহের সম্মতি উন্নত করবে এবং নকল পণ্যের ধূসর বাজার দূর করবে।
ভারত-যুক্তরাজ্য এফটিএ ভারতের হুইস্কি বাজারে একটি দ্বৈত সম্ভাবনা তৈরি করেছে। একদিকে, এটি প্রিমিয়াম হুইস্কি প্রস্তুতকারকদের জন্য খরচ কমানো এবং গ্রাহকদের জন্য আরও পছন্দের সুযোগ সৃষ্টি করবে। অন্যদিকে, দেশীয় শিল্পের উপর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ বাণিজ্য চুক্তির জন্য এর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। সরকার এবং শিল্প নেতাদের মধ্যে সুষম নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা প্রয়োজন, যাতে দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোর প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকে এবং ভারত বিশ্বের হুইস্কি বাজারে নেতৃত্ব বজায় রাখতে পারে।