পশ্চিমবঙ্গের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা (MSME) খাত গত কয়েক বছরে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। জুতো কারখানা, পোশাক তৈরি, মিষ্টি শিল্প, ছোট হোটেল, ই-রিকশা ব্যবসা, স্যালন, গ্রোসারি দোকান, ফার্নিচার ওয়ার্কশপ, পরিবহন চালান—এমন অসংখ্য ছোট ব্যবসা রাজ্যের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। কিন্তু তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যাই হল ব্যবসা বাড়ানোর জন্য দ্রুত লোন পাওয়া। ব্যাংকে গেলে যেখানে দীর্ঘ কাগজপত্র, নিরাপত্তা জামানত, গ্যারান্টর এবং সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়ার কারণে অনেকেই নিরুৎসাহিত হন, সেখানে NBFC বা নন-ব্যাংকিং ফিনান্স কোম্পানিগুলি সহজ শর্তে দ্রুত লোন অনুমোদন করায় MSME মালিকরা এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই NBFC–কে বেশি পছন্দ করছেন।
২০২৫ সালের শুরুতে প্রকাশিত আর্থিক তথ্য বলছে—পশ্চিমবঙ্গের মোট MSME ঋণের প্রায় ৫৩ শতাংশ এখন আসছে NBFC ও ফিনটেক লেন্ডারদের মাধ্যমে। ব্যাংকগুলির তুলনায় এই সংখ্যা হঠাৎ বাড়ার কারণ গত দুই বছর ধরে MSME খাতে গুরুতর অর্থের প্রয়োজন, কর্মসংস্থান বাড়ানো, এবং মহামারির পর গতি ফিরে পাওয়া।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—ছোট ব্যবসার ক্ষেত্রে ঋণ প্রাপ্তির দুটি প্রধান বিষয়—দ্রুততা এবং সহজলভ্যতা। আর এই দুই বিষয়েই NBFC–রা ব্যাংককে ছাপিয়ে গেছে।
প্রথমত, ব্যাংক থেকে লোন পেতে গেলে ন্যূনতম ১৫–৩০ দিন বা তারও বেশি সময় লাগে। কিন্তু NBFC–র লোন অনুমোদন ২৪ ঘণ্টা থেকে ৭ দিনের মধ্যে হয়ে যায়। অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এমন হয় যে, লোন পেতে দেরি করলে সুযোগ হাতছাড়া হয়—নতুন মেশিন কেনা, দোকান ভাড়া দেওয়া, মালামাল স্টক করা, বা ব্যবসার নতুন অর্ডার পাওয়া—সবই দ্রুত সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। NBFC লোনের এটাই বড় সুবিধা।
দ্বিতীয়ত, NBFC–রা সাধারণত জামানত ছাড়া (Unsecured Loans) MSME মালিকদের লোন দেয়। ব্যাংকগুলো যেদিকে নিরাপত্তা জামানত, ব্যবসার ট্র্যাক রেকর্ড, IT রিটার্ন, গ্যারান্টর—এসব চাই, NBFC–রা সেখানে দৈনন্দিন ব্যবসার নগদ প্রবাহ, দোকানের লেনদেন, GST ডেটা, UPI ট্রান্স্যাকশন—এসব দেখেই লোন অনুমোদন করে দেয়।
উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে—হাওড়ার এক ফার্নিচার দোকান মালিকের প্রয়োজন ছিল মাত্র ২ লাখ টাকার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল। ব্যাংক জামানত চাইছিল, কিন্তু NBFC মাত্র ৩ দিনের মধ্যেই সেই লোন দিয়ে দেয়। এমনই দৃষ্টান্ত দিনাজপুর, মালদা, নদিয়া, কলকাতা এবং উত্তর ২৪ পরগনার অসংখ্য ছোট ব্যবসায় দেখা যাচ্ছে।
তৃতীয়ত, NBFC–দের বড় আকর্ষণ হলো ফ্লেক্সিবল EMI সিস্টেম। কেউ প্রতি সপ্তাহে EMI দেয়, কেউ প্রতি মাসে। অনেক NBFC ব্যবসার মৌসুম অনুযায়ী EMI কম-বেশিও করে দেয়। যেমন—ঈদের সময় পোশাক ব্যবসায় বেশি আয় থাকে, আবার শীতের আগে লৌহজাত দ্রব্যের ব্যবসায় লাভ বাড়ে। NBFC–রা এই মৌসুমি ওঠানামার ওপর ভিত্তি করে EMI সেট করে।
চতুর্থত, NBFC–র লোনে ডিজিটাল ডকুমেন্টেশন সবচেয়ে বড় সুবিধা। আধার, প্যান, দোকানের লাইসেন্স, একটি বা দুটি ব্যাংক স্টেটমেন্ট—এতেই অনেক NBFC লোন প্রক্রিয়া শেষ করে দেয়। এর ফলে গ্রামের ও মফস্বলের ব্যবসায়ীরা, যাদের কাছে কাগজপত্র কম, তারাও লোন পেয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে ব্যাংকগুলো এখনও MSME লোনে ঝুঁকি নিতে অনিচ্ছুক। তারা বেশি গুরুত্ব দেয় বড় শিল্প, হাউজিং লোন, গাড়ির লোন—এসব খাতে। MSME খাতে NPA (বকেয়া ঋণ) বাড়ার ঝুঁকি থাকায় ব্যাংকগুলির মনোভাব আরও সতর্ক। ফলে ছোট ব্যবসার দিকে তাদের মনোযোগ কমছে।
এমন পরিস্থিতিতে NBFC–রা শুধু লোন দিচ্ছে না, বরং ব্যবসার বৃদ্ধির সঙ্গী হয়ে উঠছে। দোকানের মালিকদের ডিজিটাল পেমেন্ট চালু করতে সাহায্য করছে, GST ফাইলিং শেখাচ্ছে, খরচ কমানোর কৌশল পরামর্শ দিচ্ছে, এমনকি কিছু NBFC ইনভয়েস ফাইন্যান্সিং এবং মেশিনারি লোনও দিচ্ছে।
তবে NBFC–র লোনে একটি বড় ঝুঁকিও রয়েছে—সুদের হার তুলনামূলক বেশি। যেখানে একটি ব্যাংক MSME লোনে ১১–১৪% সুদ নিয়ে থাকে, NBFC–রা সেখানে ১৫–২৪% পর্যন্ত সুদ নেয়। তাই ছোট ব্যবসার মালিকদের EMI হিসাব বুঝে লোন নেওয়া জরুরি।
২০২৫ সালে ভারতের MSME লোন বাজার ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলার ছুঁতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের বাণিজ্যিক পরিবেশ ফুড প্রসেসিং, জুতো ও চামড়ার শিল্প, হ্যান্ডলুম, কাঠের কাজে যুক্ত ব্যবসা—এসব খাতে আরও বেশি NBFC লোনের চাহিদা বাড়বে বলেই ধারনা করা হচ্ছে।
সব মিলিয়ে, পশ্চিমবঙ্গের ছোট ব্যবসায়ীরা কেন NBFC লোনকে বেশি পছন্দ করছেন তার উত্তর স্পষ্ট- দ্রুত লোন, কম কাগজপত্র, জামানতহীন সুবিধা এবং ব্যবসার সঙ্গে মিলিয়ে EMI। আর ব্যাংকগুলির ধীর, কাগজপত্র-নির্ভর ও সতর্ক নীতি MSME মালিকদের NBFC–র দিকে আরও ঠেলে দিচ্ছে।
