অনেকেই জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে জীবন বিমা (Life insurance) পলিসি গ্রহণ করেন এবং স্বাভাবিকভাবেই স্ত্রী, সন্তান বা পিতামাতাকে নমিনি হিসেবে উল্লেখ করেন। উদ্দেশ্য একটাই—দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু ঘটলে প্রিয়জনেরা যেন আর্থিক সহায়তা পান। কিন্তু অনেক সময় এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে, যেখানে দুর্ঘটনায় পলিসিধারী এবং নমিনি দু’জনেই প্রাণ হারান। তখন প্রশ্ন ওঠে, এই বিমা পলিসির টাকা আসলে কে পাবে?
একই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে কী হয়?
ভারতের বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা IRDAI (Insurance Regulatory and Development Authority of India) অনুযায়ী, যদি পলিসিধারী ও নমিনি একই দুর্ঘটনায় মারা যান, তবে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় যে পলিসিধারীর মৃত্যুই আগে হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নমিনির আইনি উত্তরাধিকারীরাই বিমা দাবির জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হন।
তবে বিমা কোম্পানির নিজস্ব নিয়ম এবং বিমা পলিসির শর্ত অনুযায়ী কিছু ভিন্নতা থাকতে পারে। তাই নির্দিষ্ট দাবি করার আগে পলিসির কাগজপত্র ভালোভাবে দেখে নেওয়া উচিত।
আইন অনুযায়ী কারা উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচিত?
বিমা বিশেষজ্ঞ মনোজ জৈন জানিয়েছেন, যদি নমিনি না থাকেন বা নমিনিও মারা যান, তাহলে আইনি উত্তরাধিকারীরা বিমার টাকা দাবি করতে পারেন। এই উত্তরাধিকারী কারা হবেন, তা নির্ভর করে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন, ১৯৫৬ (Hindu Succession Act, 1956) অনুযায়ী।
একজন পুরুষ পলিসিধারীর ক্ষেত্রে:
Class 1 উত্তরাধিকারী:
- স্ত্রী
- পুত্র ও কন্যা
- মা
- যদি পুত্র বা কন্যা জীবিত না থাকেন, তবে তাঁদের সন্তানরাও দাবি জানাতে পারেন।
Class 2 উত্তরাধিকারী (যদি Class 1 না থাকেন):
- পিতা
- ভাই ও বোন
- ভাইপো ও ভাইঝি
- ঠাকুরদা-ঠাকুমা ইত্যাদি
কোনো উত্তরাধিকারী না থাকলে:
যদি উপরে উল্লিখিত শ্রেণীতে কোনো উত্তরাধিকারী না থাকেন, তবে পিতামাতার দিকের দূর সম্পর্কের আত্মীয় যেমন মামাতো বা চাচাতো ভাই/বোনরাও দাবি জানাতে পারেন। একেবারে কোনো দাবিদার না থাকলে, বিমার অর্থ সরকারের তহবিলে স্থানান্তর করা হয়।
একজন মহিলা পলিসিধারীর ক্ষেত্রে:
প্রথমে স্বামী, পুত্র ও কন্যা দাবি জানাতে পারেন। এঁরা না থাকলে, স্বামীর পরিবার—অর্থাৎ শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ ইত্যাদি প্রাধান্য পান। এরপর বিবেচনায় আসে নারীর নিজের পিতামাতার পরিবার। তবে, যদি পলিসিধারী মহিলা একটি ইচ্ছাপত্র (will) রেখে যান, তবে সেটিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যদি উইল (Will) থাকে?
যদি পলিসিধারীর ইচ্ছাপত্র থাকে, তাহলে সেখানে যাঁদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁরাই বিমার অর্থ পাওয়ার দাবি করতে পারবেন। এটি আইনি দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ এবং পলিসি সংক্রান্ত যেকোনো জটিলতা সমাধানে সহায়ক।
বিমার টাকা দাবি করতে কী কী নথি লাগে?
বিমার টাকা দাবি করার সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি জমা দিতে হয়, যেমন:
- পলিসিধারী ও নমিনির মৃত্যুর সার্টিফিকেট
- বিমা পলিসির মূল কপি বা সত্যায়িত অনুলিপি
- আইনি উত্তরাধিকারী শংসাপত্র (স্থানীয় তহসিল অফিসার বা রাজস্ব অফিসার থেকে সংগ্রহযোগ্য)
- উইল এর সত্যায়িত কপি (যদি থাকে)
- সাকসেশন সার্টিফিকেট (বিশেষ করে বড় অঙ্কের বা বিতর্কিত দাবির ক্ষেত্রে, আদালত থেকে নিতে হয়)
- দাবিদারের পরিচয় ও ঠিকানার প্রমাণপত্র (যেমন আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ভোটার আইডি ইত্যাদি)
বিমার অর্থ না থাকলে কোথায় যায়?
প্রশ্ন: যদি বিমার দাবির জন্য কোনো বৈধ উত্তরাধিকারী না থাকে, তাহলে সেই অর্থ কোথায় যায়?
উত্তর: B. সরকারকে হস্তান্তর করা হয়
(সঠিক উত্তর)
জীবন বিমা কেবল একটি আর্থিক নিরাপত্তা নয়, এটি প্রিয়জনদের জন্য একটি দায়িত্বের প্রতিফলন। তাই বিমা পলিসি নেওয়ার সময় শুধু নমিনি নির্ধারণ করলেই চলবে না, একটি স্পষ্ট ইচ্ছাপত্র রেখে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ, যাতে এমন মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে পরিবার কোনও আইনি জটিলতায় না পড়ে। তেমনই, নমিনি এবং উত্তরাধিকারীর পার্থক্য বুঝে নেওয়াও জরুরি, কারণ অনেক সময় নমিনি থাকলেও আইনি উত্তরাধিকারীরাই প্রাপ্য হন। বিমা দাবি সংক্রান্ত জটিলতায় কোনও সন্দেহ থাকলে, একজন অভিজ্ঞ আইনজীবী বা আর্থিক উপদেষ্টার সঙ্গে পরামর্শ করাই সর্বোত্তম।