কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের জন্য অষ্টম বেতন কমিশন (8th Pay Commission) নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে হোয়াটসঅ্যাপ এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এই কমিশন কার্যকর হবে বলে ঘোষণার পর থেকে, বেতন বৃদ্ধি, ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর, এবং পেনশন সংস্কার নিয়ে বিভিন্ন তথ্য ভাইরাল হচ্ছে। কিন্তু এই তথ্যগুলোর মধ্যে কতটা সত্য এবং কতটা মিথ্যা? এই প্রতিবেদনে আমরা অষ্টম বেতন কমিশন নিয়ে ছড়িয়ে পড়া হোয়াটসঅ্যাপ গুজবগুলোর সত্যতা যাচাই করব এবং বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেব।
অষ্টম বেতন কমিশনের বর্তমান অবস্থা
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা অষ্টম বেতন কমিশন গঠনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে, যা ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। তবে, কমিশনের চেয়ারম্যান, সদস্য এবং টার্মস অফ রেফারেন্স (ToR) এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এই বিলম্বের কারণে সোশ্যাল মিডিয়া এবং হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু গুজব দাবি করছে যে বেতন ৩ গুণ বাড়বে বা ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ হবে, যা সর্বনিম্ন বেতন ৫১,০০০ টাকায় নিয়ে যাবে। কিন্তু এই তথ্যগুলোর কোনো অফিসিয়াল নিশ্চিতকরণ নেই।
হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে পড়া জনপ্রিয় গুজব
১. বেতন ৩ গুণ বাড়বে: হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে পড়া একটি জনপ্রিয় গুজব দাবি করছে যে অষ্টম বেতন কমিশনের পর কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের বেতন তিন গুণ বাড়বে। উদাহরণস্বরূপ, ২০,৩০০ টাকার বেসিক বেতন ৫৮,০০০ টাকায় উন্নীত হবে। তবে, এই দাবি অতিরঞ্জিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ১.৯২ থেকে ২.৮৬-এর মধ্যে হতে পারে, যা বেতন ২৫-৩০% বাড়াতে পারে।
২. ৬ পে-লেভেল বিলুপ্ত হবে: আরেকটি গুজব দাবি করছে যে অষ্টম বেতন কমিশন ৬টি পে-লেভেল বিলুপ্ত করে ৩টি লেভেলে রূপান্তরিত করবে, যা বেতন এবং প্রমোশনের গতি বাড়াবে। এই তথ্যেরও কোনো অফিসিয়াল নিশ্চিতকরণ নেই। বর্তমানে, কমিশনের টার্মস অফ রেফারেন্স ঘোষণা না হওয়ায় এই ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা অনিশ্চিত।
৩. ২০২৬-এর আগে কমিশন গঠন হবে না: হোয়াটসঅ্যাপে কিছু বার্তা দাবি করছে যে মোদী সরকার অষ্টম বেতন কমিশন গঠন করতে চায় না এবং এটি ২০২৭ সালের পরে বাস্তবায়িত হবে। এই দাবি আংশিক সত্য, কারণ চেয়ারম্যান এবং ToR-এর ঘোষণায় বিলম্ব হচ্ছে। তবে, সরকার ২০২৬ সালে কমিশন কার্যকর করার পরিকল্পনা করছে।
৪. পেনশন পুনরুদ্ধারের সময়কাল ১২ বছরে কমবে: আরেকটি গুজব দাবি করছে যে পেনশনের কমিউটেশন পুনরুদ্ধারের সময়কাল ১৫ বছর থেকে ১২ বছরে কমানো হবে। জাতীয় কাউন্সিল (জেসিএম) এই দাবি উত্থাপন করেছে, তবে এটি এখনও অনুমোদিত হয়নি।
সত্যতা যাচাই
অফিসিয়াল ঘোষণা: সরকার ২০২৫ সালের ১৬ জানুয়ারি অষ্টম বেতন কমিশন গঠনের অনুমোদন দিয়েছে, তবে ToR এবং চেয়ারম্যান নিয়োগে বিলম্ব হচ্ছে। ডিপার্টমেন্ট অফ পার্সোনেল অ্যান্ড ট্রেনিং (DoPT) আন্ডার সেক্রেটারি পদের জন্য আবেদনের সময়সীমা তিনবার বাড়িয়েছে, সর্বশেষ ৩১ জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত।
বেতন বৃদ্ধি: ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৬ থেকে ২.৮৫-এর মধ্যে হতে পারে, যা বেতন এবং পেনশন ২৫-৩০% বাড়াতে পারে। তবে, ৩ গুণ বেতন বৃদ্ধির দাবি অতিরঞ্জিত।
পেনশন সংস্কার: পেনশন পুনরুদ্ধারের সময়কাল কমানোর প্রস্তাব রয়েছে, তবে এটি এখনও চূড়ান্ত নয়।
মিথ্যা তথ্যের প্রভাব: হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে পড়া গুজব পেনশনভোগী এবং কর্মচারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি এবং হতাশা সৃষ্টি করছে। এই গুজবগুলো মোরাল কমিয়ে দিচ্ছে এবং সরকারের উপর আস্থার ঘাটতি তৈরি করছে।
হোয়াটসঅ্যাপ গুজবের বিপদ
হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে পড়া গুজব শুধু অষ্টম বেতন কমিশন নিয়েই সীমাবদ্ধ নয়। সম্প্রতি, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে চাকরি, বিনিয়োগ এবং অন্যান্য জালিয়াতির ঘটনা বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ম্যাঙ্গালোরে একজন পেশাদার ৬.৫ লক্ষ টাকা এবং হায়দ্রাবাদে একজন অবসরপ্রাপ্ত সফটওয়্যার কর্মী ৩ কোটি টাকা হারিয়েছেন হোয়াটসঅ্যাপ জালিয়াতির কারণে। এই ঘটনাগুলো দেখায় যে অপরিচিত হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বা লিঙ্কের উপর ভরসা করা ঝুঁকিপূর্ণ।
কী করবেন?
- অফিসিয়াল উৎসের উপর ভরসা করুন: অষ্টম বেতন কমিশন সম্পর্কিত তথ্যের জন্য সরকারি ওয়েবসাইট, যেমন DoPT বা ফিনান্স মিনিস্ট্রির অফিসিয়াল বিজ্ঞপ্তি দেখুন।
- হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সতর্ক থাকুন: অপরিচিত গ্রুপ বা লিঙ্ক থেকে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই না করে বিশ্বাস করবেন না।
- বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন: বেতন বা পেনশন সম্পর্কিত সন্দেহ থাকলে সরকারি কর্মচারী সংগঠন বা আইনি উপদেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
- সাইবার নিরাপত্তা: হোয়াটসঅ্যাপে প্রাপ্ত কোনো লিঙ্কে ক্লিক করার আগে তার সত্যতা যাচাই করুন।
অষ্টম বেতন কমিশন নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে পড়া গুজবগুলোর মধ্যে অধিকাংশই অতিরঞ্জিত বা ভিত্তিহীন। সরকার ২০২৬ সালে কমিশন কার্যকর করার পরিকল্পনা করলেও, ToR এবং চেয়ারম্যান নিয়োগে বিলম্বের কারণে অনিশ্চয়তা রয়েছে। বেতন বৃদ্ধি ২৫-৩০% হতে পারে, তবে ৩ গুণ বৃদ্ধি বা পে-লেভেল বিলুপ্তির দাবি এখনও নিশ্চিত নয়। হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া মিথ্যা তথ্য থেকে সাবধান থাকুন এবং শুধুমাত্র অফিসিয়াল উৎসের উপর নির্ভর করুন। এই গুজবগুলো কেবল বিভ্রান্তিই সৃষ্টি করে না, বরং কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের মধ্যে অহেতুক প্রত্যাশা তৈরি করে। সঠিক তথ্যের অপেক্ষায় থাকুন এবং সাইবার জালিয়াতির হাত থেকে নিরাপদ থাকুন।